বর্তমানে দেশের বৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সদ্যবিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের পথেই হাঁটলেন নতুন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। গত সোমবার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গল চাইলেও সংস্থাটি কোনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবে না। এর ফলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনার শেষ আশার আলোটুকুও নিভে গেল। এদিকে ঋণ সহায়তা বাতিলের পরও আলোচনার পথ খোলা রেখেছিল বাংলাদেশ সরকার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অভিযোগ করে বলেছেন, বিশ্বব্যাংক আমাদের আলোচনার প্রস্তাবকে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি। একগুঁয়েমি করে তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
সম্ভাব্য দুর্নীতির প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে ঋণ বাতিল পর্যন্ত সব ধরনের আলোচনায় বড় বাধা ছিল বিশ্বব্যাংক। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শেষ মুহূর্তে আলোচনা করার যে ঘোষণা দিয়েছেন তাও বন্ধ হয়ে গেল নতুন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের মন্তব্যে। বিশ্বব্যাংক ঋণসহায়তা বাতিলের পর আলোচনার পথ খোলা রেখেছিল বাংলাদেশ সরকার। অর্থমন্ত্রী দেশের স্বার্থে যে মুহূর্তে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সংস্থাটির নয়া প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম জানিয়ে দিলেন, ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক। তারা বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গল চাইলেও কোনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবে না। কিমের এই মন্তব্যের মধ্যদিয়ে আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে গেল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
গত শুক্রবার বিশ্বব্যাংকের সদ্যবিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক শেষ কর্মদিবসে বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তা বাতিল করেন। সোমবার জিম ইয়ং কিম ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়েই বিশ্বব্যাংককে সমর্থন করে এই বক্তব্য দেন। অর্থমন্ত্রী অভিযোগ করে বলেছেন, বিশ্বব্যাংক তাদের আলোচনায় কোনো গুরুত্ব দেয়নি। সংস্থাটি একগুঁয়েমি করে তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক।
অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, গত আগস্টে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শিক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে। ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেল গেরেরো ওয়াশিংটন থেকে উড়ে এসে কিছু ই-মেইল বার্তা প্রদান করে যাতে দুর্নীতির হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ওই সময়ই অর্থমন্ত্রী আলোচনার কথা বলেন। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংককে একটি চিঠিও দেন। অর্থমন্ত্রী ২৫ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে যান আলোচনার জন্য। বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভা শেষে সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু তাতে তারা কোনো সাড়া না দিয়ে অভিযোগ ওঠা এসএনসি লাভালিনের দুর্নীতি তদন্তে কানাডিয়ান পুলিশের রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আবারো অর্থমন্ত্রী আলোচনার প্রস্তাব দেন। এমনকি ১৮ অক্টোবর বিশ্বব্যাংককে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, তারা যেন দুর্নীতি তদন্ত এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকে দুভাগে ভাগ করে। একদিকে দুর্নীতির তদন্ত হবে অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলবে। এতেও রাজি হয়নি দাতা সংস্থাটি। উল্টো লাভালিনের তদন্ত আরো জোরদার করতে বলা হয়। পরিস্থিতি উত্তরণে গত ৯ মাসে বিশ্বব্যাংককে ৮টি চিঠি দিয়েছে সরকার।
চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে বর্দ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পদ্মা সেতুর বিষয়ে আলোচনা করেন আবাসিক প্রতিনিধি এলেন গোল্ডস্টেইন। ১১ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশে ফিরে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তখন জানানো হয় আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে পদ্মা সেতুর ভাগ্য নির্ণয়ে। তখনই বোঝা যায় ওয়াশিংটনের আলোচনা নেতিবাচক হয়েছে।
একাধিকবার আলোচনার প্রস্তাব দেওয়ার পর বিশ্বব্যাংক অপমানজনক শর্ত জুড়ে দেয়। ওই শর্তে বাংলাদেশের স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিশ্বব্যাংকের মনোনীত আন্তর্জাতিক উপদেষ্টাদের নির্দেশনায় চলতে বলা হয়। এমনকি তারা একটি টার্মস অব রেফারেন্স করার দাবি তোলে। সংস্থাটি জানায়, বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং হোক। বিশ্বব্যাংকের এই অসম্মানজনক সমঝোতা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা কোনো বিদেশি প্যানেলের সঙ্গে টার্মস অব রেফারেন্সে গ্রহণ করা সম্ভব নয় বলে প্রত্যাখ্যান করে সরকার।
সরকারের পক্ষ থেকে তোলা কোনো আলোচনাই গুরুত্ব দেয়নি বিশ্বব্যাংক। এমনকি আলোচনাগুলো পূর্ণতা পায়নি বিশ্বব্যাংকের একরোখা নীতির কারণে। অথচ পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির সূচনা করেছে বিশ্বব্যাংক। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের অনৈতিক প্রস্তাবগুলো না মানার কারণে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে সংকট তৈরি হল। এদিকে পদ্মা সেতুর ঋণসহায়তা থেকে বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সরে গেলেও তৃতীয় এবং চতুর্থ পার্টনার জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) এই প্রকল্পে ঋনসহায়তা দেবে বলে জানিয়েছে। এই প্রকল্পে জাইকা ৪০ কোটি মার্কিন ডলার এবং আইডিবি ১৪ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যা এখনো বজায় রয়েছে।