শেয়ারবাজারের টানা ৩ দিনের দরপতনকে কেন্দ্র করে গতকাল বুধবার রাজধানীর মতিঝিল ও বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে।
গতকাল বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সোয়া ২টা পর্যন্ত প্রায় আড়াই ঘণ্টা মতিঝিলের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ভবনের সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের এ বিক্ষোভ দমনে গতকাল পুলিশ ৩ রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ, লাঠিপেটা ও জলকামান ব্যবহার করে। এর আগে সাম্প্রতিক দরপতনকে কেন্দ্র করে রাজপথে বিক্ষোভ হলেও তাতে পুলিশের কোনো অ্যাকশন চোখে পড়েনি। গতকাল বিক্ষোভ দমনে পুলিশ কঠোর অবস্থান নেয়। আগের দুদিনের দরপতনের ধারাবাহিকতায় গতকালও দুই স্টক এক্সচেঞ্জে দরপতন দিয়ে লেনদেন শুরু হয়। দিন শেষে ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক আগের দিনের চেয়ে প্রায় ৩৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৯৪৮। আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) গতকাল সার্বিক মূল্যসূচক কমেছে ২২২ পয়েন্ট। একই সঙ্গে দুই বাজারে লেনদেন হওয়া বেশিরভাগ শেয়ারের দাম কমেছে। ডিএসইতে গত ৩ দিনে সাধারণ সূচক কমেছে প্রায় ৩৫৫ পয়েন্ট। সেই সঙ্গে ডিএসইতে গতকাল লেনদেন নেমে এসেছে হাজার কোটি টাকায়। দিন শেষে ঢাকার বাজারে প্রায় এক হাজার ৩০ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়। সাড়ে তিন মাসের মধ্যে এটি সর্বনিু লেনদেন। গতকাল এই পতনের প্রতিবাদে সকাল সাড়ে ১১টার কিছু সময় পর শতাধিক বিনিয়োগকারী মতিঝিল ডিএসই ভবনের সামনের রাস্তায় নেমে আসেন। এ সময় তাঁরা রাস্তায় খড়খুটো জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেন। সেই সঙ্গে পতনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ও ডিএসইকে দায়ী করে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের একটি দল মিছিলসহ বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনে জড়ো হয়। প্রধান ফটক পেরিয়ে তারা ব্যাংকের মূল ভবন এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা চালায়। কিন্তু পুলিশের অনুরোধ ও বাধার মুখে পড়ে বিক্ষোভকারীরা সেখান থেকে আবার ডিএসই ভবনের সামনে ফিরে আসে। বিক্ষোভ চলাকালে বেলা ১২টার দিকে ব্যাপক দাঙ্গা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। বেলা ১টার দিকে আসে নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত এলিট ফোর্স র্যাব। বিক্ষোভকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে বেলা ১টার পর শুরু হয় পুলিশি অ্যাকশন। বিক্ষোভ দমন ও বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে একপর্যায়ে পুলিশ তিন রাউন্ড টিয়ার গ্যাস ছোড়ে ও লাঠিপেটা করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। একপর্যায়ে ব্যবহার করা হয় জলকামান। এতে সংঘবদ্ধ বিক্ষোভকারীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বেলা সোয়া ২টার দিকে সড়কে যানচলাচল শুরু হয় ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। এর আগে বিক্ষোভকারীদের একটি প্রতিনিধি দল ডিএসইর কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের বিভিন্ন যুক্তি ও ক্ষোভের কথা জানায়। বাজার সংশ্লিষ্টদের ধারণা, মুদ্রাবাজারের নগদ টাকা বা তারল্য সংকটের কারণেই এই পতন ঘটছে। পুঁজিবাজারে ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গ্রাহকদের চাহিদামাফিক ঋণের যোগান দিতে পারছে না। এতে করে অনেক বিনিয়োগকারীর ক্ষমতাও বাড়ছে না। অন্যদিকে একশ্রেণীর বিনিয়োগকারী পুঁজি বাঁচাতে শেয়ার বিক্রি করছেন। এতে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ার কারণে শেয়ারের দাম কমছে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, কিছুদিন ধরে বাজারের অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে বড় বড় বিনিয়োগকারী হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। নতুন করে তাঁরা কোনো ধরনের বিনিয়োগে না গিয়ে বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। ফলে বড় বড় বিনিয়োগকারীর ফান্ড অলস পড়ে রয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) বাজারের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বলে জানা গেছে। বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে সংস্থাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা চাওয়াসহ নানা ব্যবস্থা নিয়েছে। এসইসির সদস্য ইয়াছিন আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেয়ারবাজারের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আমরা খুবই সজাগ। বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাজারের স্বার্থে এসইসি সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এরই মধ্যে এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি।’ বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শেয়ারবাজারের উত্থান-পতন থাকবেই। বাজার একনাগাড়ে যেমন বাড়তে পারে না, তেমনি ধারাবাহিকভাবে পড়তেও পারে না। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি এসইসি সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। কেউ কোনো ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে বাজারকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে তীক্ষœ নজর রাখা হচ্ছে।’ ডিএসই সভাপতি শাকিল রিজভীসাংবাদিকদের বলেন, ‘অতি মূল্যায়িত শেয়ার কেনা থেকে বিরত থাকার জন্য বার বার সতর্ক করেছি বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু তাঁরা কথা শোনেননি। এখন সেসব অতি মূল্যায়িত শেয়ারের দাম কমার ফলে বিনিয়োগকারীদের মূলধনে হাত পড়েছে। সে কারণে তাঁরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। ভাঙচুর না করে তাঁদের ধৈর্য ধরা উচিত।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তিন বছর পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘুম ভাঙল। পুঁজিবাজারের মূল্য সংবেদনশীল বিষয়ে হঠাৎ করে বাংলাদেশ ব্যাংক একা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই এই বিপত্তি ঘটেছে। শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের মাত্রা কমাতে জামানতের হার হ্রাস অথবা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা শিল্পখাতের ঋণের সমন্বয় করার সময় বেঁধে দিয়ে এই বিপত্তি বাধিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সময়সীমা বেঁধে না দিয়েও সমন্বয় করা সম্ভব ছিল। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করার দরকার ছিল। দুই স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে তো নয়ই, এমনকি এসইসির সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।’ চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি ফখর উদ্দিন আলী আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, অনেক ঘটনা একসঙ্গে ঘটার কারণে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আপাতত কমিয়ে আনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকটি সিদ্ধান্তের কারণে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ গুটিয়ে রাখছে। তাছাড়া সামনে অনেক আইপিও আসছে। তাতে আবেদন করার জন্য অনেকে শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে গত কিছুদিন ধরে যেভাবে ধস নেমেছে তাতে অনেক বিনিয়োগকারীই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাঁরা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ তুলে কয়েকটি অনুমোদনহীন অবৈধ এমএলএম ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন। সেখানে বিনিয়োগকৃত টাকা ১০ মাসে দ্বিগুণ বানানোর প্রতিশ্রতি দেওয়া হচ্ছে। অবিশ্বাস্য লাভের আশায় অনুমোদনহীন ‘ইউনিপেটুইউ’, ‘স্পিক এশিয়া’, ‘টিবিআই এক্সপ্রেস’ ও ‘ভিসা র্যাব’ নামের বিভিন্ন এমএলএম ব্যবসায় বিনিয়োগ করছেন শেয়ার ব্যবসায়ীরা। ডিএসইতে গতকাল দিন শেষে ২৪৩ কম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়। এর মধ্যে ১৫৮টির দাম কমেছে, বেড়েছে ৮০ টির, আর অপরিবর্তিত ছিল পাঁচটির। লেনদেনের প্রথম ৩০ মিনিটে ডিএসইর সাধারণ সূচক প্রায় ১২০ পয়েন্ট কমে গেলেও শেষ দিকে এসে তা কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়। শেষ সময়ে বাজারে ক্রেতা বেড়ে যায়। মৌল ভিত্তিসম্পন্ন শেয়ারের দামও বাড়ে। এতে দিনের শুরুর নিুগতি শেষভাগে গিয়ে কিছুটা ধীরগতি নেয়। সিএসইতে গতকাল ১৭৯ কম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়। তার মধ্যে ১৪০টিরই দাম কমেছে, বেড়েছে ৩৭টির, আর অপরিবর্তিত ছিল দুটির।