‘অবিশ্বাস্য একটা পথ পাড়ি দিয়েছি আমি। কিন্তু সবসময় মনে দৃঢ়বিশ্বাস ছিল-আমি পারব। এমন কিছু করতে চেয়েছি যেটা আগে কেউ করতে পারেনি। এই মুহূর্তে সতীর্থদের সাহায্যে সেই জায়গাটিতেই পৌঁছেছি আমি। ওদের কাছে তাই আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। তবে বিজয় মঞ্চে দাঁড়ানোর আগে সতীর্থদের বলেছি, ওদের সঙ্গে রাতে গান গাইতে পারব না। কারণ বুকে এত বেশি আবেগ জমা হয়েছে যে, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুবে না।’ অলিম্পিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ১৯টি পদক জিতে, ৪৮ বছরের পুরনো রেকর্ড ভেঙে এর বেশি আর বলতে পারেননি যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তিতুল্য সাঁতারু মাইকেল ফেলপস।
কথায় বলে, রেকর্ড গড়া হয় ভাঙার জন্য। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের জিমন্যাস্ট লারিসা লাতিনিনা তিনটি অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি ১৮টি অলিম্পিক পদক জয়ের যে রেকর্ড গড়েছিলেন, ফেলপস মঙ্গলবার রাতে তা ভেঙে দেন লন্ডনের অ্যাকুয়াটিক সেন্টারে। অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি ১৯টি পদক জয়ের রেকর্ড এখন ফেলপসের দখলে। লারিসার রেকর্ডটি টিকে ছিল প্রায় ৪৮ বছর। কিন্তু ফেলপস সেটিকে যে উচ্চতা দিতে যাচ্ছেন তার আয়ু কত হতে পারে, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। এখনও তার তিনটি ইভেন্ট বাকি।
সবচেয়ে বেশি অলিম্পিক পদক জয়ের রেকর্ড গড়া ছিল ফেলপসের জন্য সময়ের ব্যাপার। লন্ডনে এসেছিলেন এথেন্স এবং বেইজিং অলিম্পিকে মোট ১৬টি পদক জিতে। যার মধ্যে ১৪টিই হল স্বর্ণপদক এবং দুটি ব্রোঞ্জ। মঙ্গলবার ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে রৌপ্য জিতে লারিসার রেকর্ড স্পর্শ করেন তিনি। পরে ৪–২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেতে দলগত স্বর্ণ জিতে সবচেয়ে বেশি অলিম্পিক পদক জয়ের রেকর্ড নিজের করে নেন।
রিলে ইভেন্ট দিয়ে লন্ডন অলিম্পিকে প্রথম স্বর্ণপদকও জিতলেন ফেলপস। এ চার দিনে দুটি ব্যক্তিগত এবং দুটি দলীয় ইভেন্টে অংশ নিয়ে তিনটি পদক জিতেছেন তিনি। লারিসার রেকর্ড ভাঙার জন্য যে কোনো রংয়ের তিনটি পদক হলেই হতো ফেলপসের। সেটি হয়ে গেছে। এখন বাকি তিনটি ইভেন্ট থেকে পদক জিততে পারলে নিশ্চিতভাবেই অধরা এক উচ্চতায় পৌঁছে যাবেন তিনি। সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ানের স্বীকৃতি পেতে আর কী চাই!
সোজা কথায় ফেলপস এখন কিংবদন্তিদের কিংবদন্তি। পরপর দুই অলিম্পিকে রেকর্ড ১৪টি স্বর্ণপদক জিতে কিংবদন্তির কাতারে আগেই আসন পেয়েছেন তিনি। বেইজিং অলিম্পিকে রেকর্ড গড়েছিলেন আটটি স্বর্ণপদক জিতে। পেছনে ফেলেছিলেন স্বদেশি মার্ক স্পিজকে। যিনি ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে জিতেছিলেন সাতটি স্বর্ণপদক। তারপর থেকেই চলছিল লন্ডন অলিম্পিকের অপেক্ষা। তবে লন্ডনে শুরুতে একটু খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মিডলের বাছাইয়ে বাদ পড়তে পড়তে অষ্টম হয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন। ওই ইভেন্ট জিততে পারলে পরপর তিন অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের রেকর্ড হতো। স্বর্ণ দূরে থাক, পদকই পাননি। চতুর্থ স্থানে থেকে শেষ করেছেন সাঁতার। তার স্বদেশি রায়ান লোচেট জিতেছেন স্বর্ণপদক।
পরের ইভেন্টে যুক্তরাষ্ট্র পুরুষ দল ৪–১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেতে ফ্রান্সের কাছে হেরে দ্বিতীয় হয়। স্বর্ণের বদলে রৌপ্য নিয়ে লন্ডন অলিম্পিক গেমসে প্রথম পদক জয়ের স্বাদ নেন জলদানব। এরপর প্রিয় ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে রেকর্ড তৃতীয় স্বর্ণ জয়ের হাতছানি ছিল। মনে মনে তৈরিও ছিলেন ফেলপস। সাঁতারবোদ্ধাদের বিশ্বাস ছিল, এ ইভেন্টে ফেলপস জিতবেনই। কিন্তু অল্পের জন্য হেরে যান দক্ষিণ আফ্রিকার ২০ বছর বয়সী এক তরুণের কাছে। ক্যাড লে ক্লস ১ মিনিট ৫২.৯৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথমবারের মতো অলিম্পিক গেমসে স্বর্ণপদক জেতেন। রৌপ্য নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ফেলপসকে। এথেন্স এবং বেইজিংয়ে যার পায়ের কাছে অলিম্পিক এবং বিশ্বরেকর্ড লুটোপুটি খেয়েছে, সেই ফেলপস ১ মিনিট ৫৩.০১ সেকেন্ডে দ্বিতীয় স্থানে শেষ করেন ২০০ মিটার বাটারফ্লাই। তবে এ পদকটি পেয়েই তিনি বসে যান লারিসার পাশে।
তারপরই ইতিহাস। ৪–২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণপদক এবং ফেলপসের নতুন কীর্তি। এথেন্সের পর বেইজিংয়ে যে চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন ফেলপস আটটি পদক জিতে, তার সফল পরিণতি টানলেন লন্ডনে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে। যে উচ্চতায় পৌঁছানোর মতো কাউকে তো দূরবীণ দিয়েও দেখা যাচ্ছে না!