বুধবার ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার শোকে কাঁদছে সারা বিশ্ব। পিতামাতার গ্যারেজ থেকে তিনি বন্ধু স্টিভ ওজনিয়াককে সঙ্গে নিয়ে প্রটোটাইপ (নমুনা) কম্পিউটার নিয়ে শুরু করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্বসভায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্টিভ জবস। প্রতিষ্ঠা করেন কম্পিউটার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাপল। স্টিভ জবস।

 ১৯৫৫ সালের ২৪শে ফ্রেব্রুয়ারি স্টিভ সান ফ্রান্সিসকোতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি আতারি নামের এক ভিডিও গেমস কোম্পানিতে চাকরি নেন। কিন্তু ভারত সফর করার জন্য কয়েক মাসের মাথায়ই তিনি সেখান থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সাল থেকেই মূলত প্রযুক্তিবিদ স্টিভ জবসের যাত্রা শুরু হয়। এ বছর তিনি তার বন্ধু স্টিভ ওজনিয়াককে সঙ্গে নিয়ে তার পিতা-মাতার গ্যারেজে একটি প্রটোটাইপ কম্পিউটার নিয়ে কাজ শুরু করেন। সে কাজটি যে তাকে এতদূর পৌঁছে দেবে তা হয়তো তিনি নিজেও ওই সময় ভাবেননি। ১৯৭৬ সালেই ওজনিয়াককে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাপল কম্পিউটার। এর পরই শুরু করেন তাদের উদ্ভাবিত মেশিন বিক্রি করা। তারা শুরু করেন অ্যাপল-১ দিয়ে। এরপর ১৯৭৭ সালে বাজারে ছাড়েন অ্যাপল-২। এ কম্পিউটারটি ব্যাপক বাজার পায়। ফলে পরের ১৬ বছর তিনি এ কম্পিউটারটির উৎপাদন অব্যাহত রাখেন। ১৯৮০ সালে অ্যাপল-৩ বাজারে ছাড়েন। কিন্তু তা ব্যবসা সফল হতে ব্যর্থ হয়। এখানেই তারা থেমে যাননি। তারা ১৯৮৩ সালে ফের বাজারে ফিরে আসেন। এবার তারা প্রথমবারের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবহার উপযোগী এক স্ক্রিনের কম্পিউটার নিয়ে আসেন। এর নাম দেন লিসা। এটি একটি মাত্র মাউস দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কিন্তু এ কম্পিউটারটিও ব্যবসা সফল হয়নি। ১৯৮৪ সালে অ্যাপল চালু করে ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটার। ১৯৮৫ সালে অ্যাপল তার ৬টির মধ্যে ৩টি কারখানা বন্ধ করে দেয়। বাদ দেয় ১২০০ কর্মচারীকে। এ সময়ই বছরের প্রথম দিকে তারা লোকসানের ঘোষণা দেন। এ সময় জন সালির সঙ্গে দ্বন্দ্ব ঘটলে তাকে কোম্পানি থেকে জোর করে বের করে দেয়া হয়। ১৯৮৬ সালে স্টিভ জবস কিনে নেন লুকাস ফিল্ম লিমিটেড কোম্পানির গ্রাফিক্স ডিভিশন কোম্পানি। এ কোম্পানির মালিক ছিলেন স্টার ওয়ারস-এর প্রযোজক-পরিচালক জর্জ লুকাস। ১৯৮৭ সালে ম্যাকিন্টোশ-২ বাজারে ছাড়া হয়। ১৯৮৮ সালে স্টিভ জবস প্রতিষ্ঠা করেন নেক্সট কম্পিউটার। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানও ভাল ব্যবসা করেনি। মাত্র ৫০ হাজার কম্পিউটার বিক্রি করেছিল ওই প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৫ সালে পিক্সার এনিমেশন স্টুডিওর প্রধান নির্বাহী হিসেবে স্টিভ জবস প্রকাশ করেন টয় স্টোরি। এটিই প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের এনিমেটেড কম্পিউটার ছবি। এটি সারা বিশ্বে বক্স অফিস হিট করে। ১৯৯৬ সালে অ্যাপল ৪২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে কিনে নেয় নেক্সট ও জবসের প্রযুক্তি। তা ব্যবহার করে তারা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সফটওয়্যার বানাতে থাকে। ১৯৯৭ সালে স্টিভ জবসকে অ্যাপলের অন্তর্বর্তী প্রধান নির্বাহী করা হয়। ১৯৯৮ সালে চালু করা হয় আইম্যাক। ২০০১ সালে প্রথম আইপড বিক্রি শুরু হয়। এতে ব্যাপক সফলতা আসে। ২০০৩ সালে চালু করা হয় আইটিউনস। ২০০৭ সালে প্রথম আইফোন চালু করা হয়। ২০১০ সালে বাজারে ছাড়া হয় আইপ্যাড। ৮০ দিনে এর ৩০ লাখ বিক্রি হয়ে যায়। বছরের শেষ নাগাদ বিশ্বজুড়ে তা বিক্রি হয় ১ কোটি ৫০ লাখ। এ বছরে তারা নতুন পণ্য হিসেবে বাজারে ছাড়ে আইপ্যাড-২ ও আইফোন-৪। গত আগস্টে অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন জবস। তার স্থলাভিষিক্ত হন জবসের দীর্ঘদিনের সহকর্মী টিম কুক। শারীরিক অসুস্থতার কারণেই অ্যাপলের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত জবস পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। অ্যাপলের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়- স্টিভের মেধা, ভালবাসা এবং উদ্যমই ছিল অসংখ্য উদ্ভাবনের নেপথ্যে, যা আমাদের সবার জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। স্টিভের জন্যই বিশ্ব আজ অনেক উন্নত। অ্যাপল এ স্বপ্নদ্রষ্টার সম্মানে তাদের ওয়েবসাইটে স্টিভের সাদাকালো একটি বড় ছবি জুড়ে দিয়েছে। সেখানে লেখা, স্টিভ জবস: ১৯৫৫-২০১১। প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তরের বাইরে তাদের পতাকা অর্ধনমিত। দীর্ঘদিন ধরেই শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন স্টিভ জবস। অগ্ন্যাশয়ে বিরল ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি।

সৃষ্টিশীলতা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জবসের অসামান্য দক্ষতার কারণে অ্যাপল বিশ্বের অন্যতম প্রধান কম্পিউটার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ক্রমে অ্যাপল ও স্টিভ জবস সমার্থক হয়ে ওঠে। বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী ২০১০ সালে জবসের সম্পদের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৬.১ বিলিয়ন ডলারে। এ হিসাব অনুযায়ী আমেরিকার ধনীদের তালিকায় তার ঠাঁই হয় ৪২ নম্বরে।

প্রযুক্তি বিশ্বের এক বিপ্লবী বীর। তিনি অ্যাপল প্রতিষ্ঠা করে আমূল বদলে দিয়েছেন পৃথিবী। তিনি আর নেই। আগামী অনেক প্রজন্ম তাকে স্মরণ করবে।