প্রখ্যাত গজলশিল্পী জগজিৎ সিং গতকাল সোমবার ভারতের মুম্বাইয়ের লীলাবতী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ১০ মিনিটে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

২০০৩ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ খেতাব পাওয়া এই শিল্পী গত চার দশক ধরে একাধারে হিন্দি, পাঞ্জাবি, উর্দু, বাংলা, গুজরাটি, সিন্ধি ও নেপালি ভাষায় গান শুনিয়ে আসছেন উপমহাদেশের শ্রোতাদের। তার স্ত্রী চিত্রা সিংও একজন বিখ্যাত শিল্পী। স্ত্রী চিত্রাকে সঙ্গে নিয়ে জগজিৎ সিং ভারতে গজলের পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করেছেন বলে মনে করা হয়। এই শিল্পীদম্পতির আয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় ভারতের বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার কাজে।

বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গান গেয়ে এ দেশের শ্রোতাদেরও মুগ্ধ করেছেন গজলসম্রাট। তার কণ্ঠে গাওয়া সেই জনপ্রিয় রোমান্টিক ধাঁচের বাংলা গানগুলো শ্রোতাদের মনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ‘বেশি কিছু আশা করা ভুল,’ ‘কতো বেদনা দিলে’, ‘বেদনা মধুর হয়ে যায়, নদীতে তুফান এলে কূল ভেঙ্গে যায়’, ‘চোখে চাখ রেখে আমি সুরা পান করি’, ‘বুঝিনিতো আমি, পৃথিবীতে ভালোবাসা সবচেয়ে দামি’, ‘তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে’_ জনপ্রিয় এই গানগুলোর স্রষ্টা উপমহাদেশের প্রখ্যাত গজলশিল্পী জগজিৎ সিং।

জগজিৎ জন্মেছিলেন রাজস্থানে ১৯৪১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। বাবা অমর সিং এবং মা বচন কাউরের ১১ সন্তানের ভেতরে জগজিৎ ছিলেন তৃতীয়। ছোট একটি সরকারি বাড়িতেই শুরু হয়েছিল ভবিষ্যতের এই গজলসম্রাটের শৈশব। যেখানে না ছিল পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা, না বিদ্যুৎ। তবু এই মফস্বলের এক কোনেই বাবার উৎসাহে গানের পথে হাঁটার শুরুটা হয়েছিল জগজিৎ সিংয়ের। বাড়িতে সংগীতের পরিবেশ ছিল, যখন বাড়ির প্রাথমিক তালিম প্রায় শেষ; সে সময় জামাল খান নামের একজন তাকে বাড়িতে এসে গান শেখাতে শুরু করেন।

শিক্ষাজীবন থেকেই তার যাত্রা ক্রমশ গজলের সপ্তমাকাশে। প্রথমে ছোটখাটো গজলের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। সংগীত পরিচালকদের কাছে ক্রমশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠছিলেন তিনি। কিন্তু গজলসম্রাটের সিংহাসনটি তখনও অধরা। গায়ক নেওয়ার বেলায় সেই পরিচালকরা তখন খুঁজতেন তাদের লোকজনদের। গজলই তাকে খুঁজে দিয়েছিল তার ভালোবাসার মানসীকে, এর মাঝেই পরিচয় ঘটেছিল বাঙালি মেয়ে চিত্রা সিংয়ের সঙ্গে; তখন চিত্রা সিং হননি, জিঙ্গেল গাইতেন। বিবাহিত চিত্রার স্বামী চালাতেন একটা স্টুডিও। তার সঙ্গে জিঙ্গেলে কণ্ঠ দিতে শুরু করেন জগজিৎ। এভাবেই আবেগ ছড়ায় কণ্ঠ থেকে হৃদয়ে। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার সংযোগ কিন্তু সেই গজলই। এই সুরই কিন্তু জগজিৎকে রাজস্থান থেকে টেনে এনে ফেলেছে বাঙালি চিত্রার শ্যামলিম ভালোবাসায়।

চিত্রার স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ১৯৬৯-এর ডিসেম্বরে বিয়ে করেন জগজিৎ সিং আর চিত্রা। চিত্রার আগের পক্ষের মেয়ে মনিকাকে নিয়ে ওয়ার্ডেন রোডের ছোট্ট এক রুমের একটি বাড়িতে সংসার শুরু হয় গজল দুনিয়ার জনপ্রিয়তম জুটি জগজিৎ-চিত্রা সিংয়ের।

১৯৭১ সালে জগজিৎ-চিত্রা দম্পতির ঘরে আসে একটি পুত্র সন্তান, যার নাম রেখেছিলেন বিবেক। ১৯৭৬ সাল। এ বছরই জগজিৎ আর চিত্রা সিংয়ের প্রথম লং প্লেইং রেকর্ড বা এলপি অ্যালবাম ‘আনফরগটেনেবলস’ প্রকাশিত হয়। এর পর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জগজিৎ সিংকে।

তুমুল ব্যবসা, জনপ্রিয়তা, ছবিতে গান গাওয়ার অফার সব যেন রাজস্থানের উষর জমিতে প্লাবনের ঢলের মতোই নেমে আসে। উপমহাদেশের সংগীতাকাশে মেহেদি হাসান, নূরজাহান, বেগম আখতার এবং তালাত মাহমুদ; যিনি ছিলেন জগজিৎয়ের আশৈশব স্বপ্নের তারকা, সেই একই আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলে ওঠেন তিনি।

প্লেব্যাক করেন প্রেম গীত (১৯৮১), সাথ সাথ, মহেশ ভাটের ডেব্যু ফিল্ম আর্থ (১৯৮২), টিভি সিরিজ মির্জা গালিব (১৯৮৮) এবং কাহকাশান (১৯৯১)।
৫ যুগের এই দীর্ঘ সময়ে জগজিৎয়ের এ পর্যন্ত ৮০টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৩ সালে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ খেতাব পদ্মভূষণে সম্মানিত এই শিল্পী।

১৯৯০-এ জগজিৎয়ের একমাত্র পুত্র বিবেক এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তখন বিবেকের বয়স মাত্র ১৯ বছর। এরপরই স্থায়ী এক অন্ধকারের দেয়াল উঠে যায় এ জুটির জীবনে। যদিও এরপরও থেমে থাকেননি জগজিৎ। কিন্তু তার স্ত্রী সুকণ্ঠী চিত্রা পুত্রশোকে গান গাওয়াই ছেড়ে দেন।