মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণ নিশ্চিত করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে বছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্যও ‘সংযত’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গভর্নর আতিউর রহমান বুধবার সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদের এই নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, “বিশ্বের অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিরও প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি পরিমিত রাখা, যাতে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। এর পাশাপাশি জাতীয় বাজেটে ঘোষিত অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনকে সমর্থন দানও মুদ্রানীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।”

এবারের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৫ ভাগে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, যাকে নতুন মুদ্রানীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন গভর্নর।

তিনি বলেন, “এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চাহিদা প্রবৃদ্ধির পরিমিতির পাশাপাশি যোগান প্রসারের দিকেও আমাদের মুদ্রানীতি সমর্থন দিয়ে এসেছে।”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশে নেমে এলেও বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘরেই ছিল। ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে মুদ্রনীতিতে বলা হয়, “২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই মূল্যস্ফীতি অস্বস্তিকর দুই অংকের ঘরে দাঁড়ায়… এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনার লক্ষ্যে গত অর্থবছরের শুরু থেকে আমরা সংযত মুদ্রানীতি গ্রহণ করি।”

গভর্নর বলেন, “বর্তমানে তার সুফল আমরা পাচ্ছি। মূল্যস্ফীতি এক অংকের ঘরে নেমে এসেছে। এই সাফল্যের ধারা অক্ষুন্ন রাখার জন্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতিতে সংযত অবস্থান গত বছরের মত এবারও ধরে রাখবে।”

প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবার বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে এই বৃদ্ধির হার ১৮ শতাংশ ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, সরকারের ঋণ যাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তারল্য কমিয়ে না দেয়- সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষভাবে নজর রাখবে। এছাড়া বিদেশি মুদ্রা বিনিময় হারের ‘অতি অস্থিরতা’ রোধ করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এতে সরকারি বন্ডের প্রাইমারি ডিলার ব্যাংকের ওপর চাপ কমাবে বলেও মুদ্রানীতিতে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।

চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।

গভর্নর বলেন, “বিদেশি মুদ্রার মজুদ এবং বছর শেষে সামগ্রিক লেনদেনের স্বস্তিকর ভারসম্যের প্রতি মুদ্রানীতির সামগ্রিক দৃষ্টি নিয়োজিত থাকবে। তবে বিশ্ব বাণিজ্যে মন্থর প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আমাদের বিদেশি মজুদের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন তেমন উচ্চাভিলাষী মাত্রায় করা হয়নি।”

“বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ টাকার বিনিময় হারে বাজারভিত্তিক নমনীয়তা বজায় রাখা এবং অস্বাভাবিক অস্থিতিশীলতা এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় সীমিত থাকবে”, যোগ করেন আতিউর।

গত অর্থবছরের পরিস্থিতি উল্লেখ করে এবারের মুদ্রানীতির ব্যাখ্যায় গভর্নর বলেন, গত অর্থবছর (২০১১-১২) ছিল ‘দুই বিপরীত পর্বের যোগফল’। প্রথমার্ধে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও বিদেশি সাহায্যের স্বল্পতা লেনদেন ভারসাম্যে প্রতিকূল চাপ সৃষ্টি করে। এতে টাকার মান পড়ে যায়; কমে আসে বিদেশি মুদ্রার মজুদ। এরই মধ্যে ব্যাংক থেকে সরকারের ধার করা বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি উঠে যায় দুই অংকে।

“এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যথেষ্ট সংযত মুদ্রানীতি গ্রহণে সচেষ্ট হই, অপ্রয়োজনীয় আমদানি চাহিদা কমিয়ে আনি, বহির্বিশ্ব থেকে বিকল্প অর্থায়নের উৎস সন্ধানেও আমরা তৎপর হই।”

এর ফলে গত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে চাপ কমে আসে, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার মাত্রাও কমে যায় বলে গভর্নর জানান।

তিনি বলেন, “গত জানুয়ারিতে গ্রহণ করা মুদ্রানীতির এই সংযত অবস্থান গত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।… ফলে আমরা অর্থবছরের শেষে এক অংকের মূল্যস্ফীতিতে নেমে আসতে সক্ষম হই।”