গাড়িবিলাসে মত্ত বীমা কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীরা। বেশ কয়েকটি বীমা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্রাহকের টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি হাঁকাচ্ছেন। এসব গাড়ির মূল্য ৭০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা। এখানেই শেষ নয়, অনেক কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরিবারের সদস্যরাও কোম্পানির কেনা দামি দামি গাড়ি ব্যবহার করেন। এ ধরনের বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারে বীমা কোম্পানির পলিসি হোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মনে করছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।

শুধু দামি গাড়ি ব্যবহার নয়, আরও নানা অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন তারা। এর মধ্যে কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। ক্যালেন্ডারসহ ছাপার কাজ, অফিসের এসি, গাড়িসহ অন্যান্য দামি পণ্য কেনা হয়ে থাকে কমিশনের ভিত্তিতে। বড় ধরনের টাকা আত্মসাত্ হয় কোম্পানির জমি, ফ্ল্যাট ক্রয় বা নির্মাণে। কোনো কোনো সময় এদের কমিশন বাণিজ্যের কারণে এসব কেনাকাটা দ্বিগুণের চেয়েও বেড়ে যায়। কোনো কোনো কোম্পানির চেয়ারম্যান-পরিচালকদের বড় বড় বাসার কেনাকাটাও হয় কোম্পানির টাকায়।

বীমা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও নির্বাহীদের অনৈতিক বাণিজ্য রোধে কঠোর হচ্ছে আইডিআরএ। এরই মধ্যে বিলাসী গাড়ি ব্যবহার বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। গত ২৪ জুলাই বীমা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের ব্যবহূত গাড়ির সর্বোচ্চ দাম ৪০ লাখ টাকা বেঁধে দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ সকালের খবরকে বলেন, পলিসি হোল্ডারদের টাকায় বিভিন্ন বীমা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও মুখ্য নির্বাহী কোটি টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার করে আসছেন। এ ধরনের গাড়ি ব্যবহার করায় বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ফলে আইডিআরএ গাড়ির সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দিয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানির টাকায় চেয়ারম্যান ও এমডিদের কোটি কোটি টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি। এ ব্যাপারে আইডিআরএকে আরও কঠোর হতে হবে। তিনি বলেন, কোম্পানির টাকায় এত দামের গাড়ি ব্যবহার করায় শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বেশিরভাগ বীমা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার ব্যবহূত গাড়ির মূল্য ৪০ লাখ টাকার বেশি। বীমা কোম্পানির পক্ষ থেকে আইডিআরএ’র কাছে পাঠানো তথ্যেই এটা জানা গেছে। যদিও বীমা কোম্পানির পক্ষ থেকে পাঠানো এসব তথ্যে গাড়ির প্রকৃত মূল্য অনেক কম দেখানো হয়েছে বলে সন্দেহ রয়েছে। তারপরও অধিকাংশ বীমা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও এমডির গাড়ির মূল্য কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। 

সূত্রে জানা গেছে, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান আলহাজ নজরুল ইসলাম ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা দামের টয়োটা প্রাডো গাড়ি ব্যবহার করছেন। বর্তমানে কোম্পানির মোট গাড়ি রয়েছে ১৬৮টি। দামি গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ঢাকা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান মো. হাসান। তিনি কোম্পানির টাকায় কেনা টয়োটা ক্লাউন মডেলের গাড়ি ব্যবহার করছেন। এর দাম দেখানো হয়েছে ৯৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। অন্যদিকে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান এমএইচ তাহের ৮৬ লাখ টাকা দামের মিত্সুবিশি পাজেরো জিপ ব্যবহার করছেন। বর্তমানে এই বীমা কোম্পানির ১৮৯টি গাড়ি রয়েছে। রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার করেন। সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলহাজ মকবুল হোসেন ৪৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার করছেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির মোট গাড়ির সংখ্যা ১৫৯টি। সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান জাহিদ মালিক ব্যবহার করেন ৪২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দামের গাড়ি।

দামি গাড়ি ব্যবহার প্রসঙ্গে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম সকালের খবরকে বলেন, গাড়িটি ২ বছর আগে কেনা। আমি কোম্পানির কাজে নিয়মিত ঢাকার বাইরে যাই। ফলে ভালো গাড়ির প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়াও গাড়িটি অফিসের কাজেই ব্যবহার করা হচ্ছে। পলিসি হোল্ডারদের টাকায় দেড় কোটি টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার কতটা নৈতিক জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

অন্যদিকে ঢাকা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান মো. হাসান ৯৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার প্রসঙ্গে বলেন, আপনি কীভাবে জানেন এটা কোম্পানির গাড়ি। আগে জেনে আমাকে ফোন দেন। গাড়িটি আপনার ব্যক্তিগত টাকায় ক্রয় করা কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মিটিংয়ে আছি। এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না।

মেঘনা লাইফের চেয়ারম্যান এমএইচ তাহের বলেন, গাড়িটি ২ বছর আগে কেনা হয়েছে। তখন গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। তিনি বলেন, এত দামি গাড়ি ব্যবহার করতে আমার নিজেরও লজ্জা লাগে। কারণ আমি একজন সাধারণ মানুষ। তারপরও কোম্পানি থেকে দিয়েছে তাই ব্যবহার করছি।