বৃহস্পতিবার বাণিজ্য  মন্ত্রণালয়ের  প্রকাশিত তদন্তে ডেসটিনি গ্রুপে ১২টি অনিয়ম এবং ৩ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম উল্ল্যেখ করা হয়।

মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি দিয়ে শুরু হওয়া ডেসটিনি গ্রুপের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।

তদন্তে ১২টি অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে জানিয়ে বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন বলেন, ডেসটিনির হিসাবের অনিয়ম পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এ জন্য দ্রুততার সঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের হিসাব-নিরীক্ষা ও অনিয়ম নিরূপণ করা হবে।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যে ১২টি অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে, তার মধ্যে ডেসটিনির ২২ জন পরিচালক অথবা শেয়ারহোল্ডারের নিজেদের মধ্যে অধিকাংশ শেয়ারের লেনদেন, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের (ডিএমসিএসএল) এর মাধ্যমে চড়া সুদে (১৬%) অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা রয়েছে।

অবৈধ ব্যাংকিং চালানোসহ বিভিন্ন অভিযোগে গত এপ্রিলে ডেসটিনি গ্রুপের কার্যক্রম খতিয়ে দেখার সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত শুরু হয়।

তদন্তে পাওয়া অনিয়মের মধ্যে আরো রয়েছে- ডেসটিনি গ্রুপভুক্ত কোনো কোনো কোম্পানির কার্যক্রম উদ্দেশ্য অনুযায়ী পরিচালিত না হওয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বচ্ছ তথ্য দেয়া এবং তথ্য গোপন, বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করা, ক্রমাগত লোকসানি প্রতিষ্ঠানে মূলধন বিনিয়োগের মাধ্যমে তহবিল তসরূফ, সমিতির অর্থ বিধিবহির্ভূতভাবে পরিচালকদের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর।

এছাড়া একচেটিয়ার পণ্যের বাজার সৃষ্টি করে চড়া মুনাফায় পণ্য সামগ্রী বিক্রি, প্রকৃত বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ক্রয়, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন না করেই বৃক্ষরোপণ প্রকল্পে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ এবং অর্থের হদিস না পাওয়া, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই ব্যবসা করা এবং ডেসটিনি ২০০০ এবং এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সমন্বয়হীনতার সন্ধান পেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ডেসটিনি গ্রুপের প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণা অনুযায়ী নিজস্ব পণ্য থাকার কথা ছিল, তবে তারা প্রতারণার মাধ্যমে অন্য প্রতিষ্ঠানের পণ্য এনে বিক্রি করেছে এবং তাদের নিজস্ব কোনো পণ্য ছিল না।

সচিব বলেন, ডেসটিনিতে দুই ধরনের আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। এতে তহবিল তসরূপ হয়েছে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা এবং সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। এ হিসেবে মোট অনিয়ম হয়েছে ৩ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকার।

এর মধ্যে শুধু ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের (ডিএমসিএসএল) আর্থিক অনিয়ম ৯৮১ কোটি ৭০ লাখ টাকা বলে তদন্তে পাওয়া গেছে।

ডেসটিনি গ্রুপের ৩৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই ১৩টি মৃত এবং অকার্যকর জানিয়ে সচিব বলেন, ২৬টি কোম্পানির অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ২৮২কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

সচিব প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাংবাদিকদের বলেন, ডেসটিনি গ্রুপের ৩৯টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চালু রাখতে কেন্দ্রীয়ভাবে একজন প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রশাসক নিয়োগ করা হলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ডেসটিনির অনিয়ম নিয়ে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার সমন্বয় করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

ডেসটিনি গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের মতো বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত কর্মীদের তাদের পাওয়া কমিশন অনুযায়ী আয়কর পরিশোধ করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ করা হবে বলে জানান সচিব।

অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন ও তার স্ত্রীসহ গ্রুপের শীর্ষ পাঁচ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে ব্যাংকগুলোতে চিঠি দেয় রাজস্ব বোর্ড।

অনিয়মের এই তদন্তের মধ্যে গত ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডেসটিনির প্রেসিডেন্ট, সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশীদ ও এমডি রফিকুল আমিনসহ ২২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের পর পাচারের অভিযোগে দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেশন (এমএলএম) ও ট্রি-প্লান্টেশেন প্রকল্পের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়া অর্থ পাচারের ‘প্রমাণ’ পেয়ে মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা দুটি করেন।

ওই দুই মামলার আসামিদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট হারুন-অর-রশিদ, এমডি রফিকুল আমিন ও চেয়ারম্যান মো. হোসেন বৃহস্পতিবার সকালে আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।