বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। তবে তার আগে বেশকিছু পরামর্শ মানতে হবে সরকারকে। গত সোমবার এডিবির প্রকাশিত প্রতিবেদনে মার্জিন ঋণের হার কমানো ও ঋণ সহায়তার বিপরীতে শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।

ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় দেওয়া ঋণের পরামর্শ হিসেবে এ ধরনের ২৫ দফা প্রস্তাব দিয়েছে এডিবি। গত ২৪ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত সফররত এডিবির ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।

শেয়ারবাজারের উন্নয়নে এডিবি দুই কিস্তিতে ২১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ সহায়তা দেবে। এ টাকায় ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ওয়ান শীর্ষক প্রকল্পের কাজ এরই মধ্যে শেষ করেছে এসইসি। চলতি মাসেই ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-২ নামে দ্বিতীয় প্রকল্পের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। বিষয়টি পুঁজিবাজারের জন্য সুসংবাদ হলেও আরোপিত ২৫টি পরামর্শ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা সংশয়ে রয়েছেন। কারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঝুঁকি কমাতে শেয়ারবাজারে এসব প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।

বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট দায়ের ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু এডিবির শর্তানুযায়ী দায়ের পরিবর্তে পরিশোধিত মূলধনের ভিত্তিতে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। এডিবির শর্তে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো তাদের পরিশোধিত মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। এটি বাস্তবায়ন হলে শেয়ারবাজার থেকে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কমিয়ে ফেলতে হবে। এছাড়া মার্জিন ঋণ বর্তমানের ১:১ হারের পরিবর্তে ১:০.৫ হারে বিতরণের শর্ত দেওয়া হয়েছে এডিবির পক্ষ থেকে। এতে শেয়ারবাজারে বর্তমানে মার্চেন্ট ব্যাংকের দেওয়া প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ অর্ধেকে নেমে আসবে। ফলে বিক্রির চাপ বেড়ে গিয়ে শেয়ারবাজারে আরেকটি ধস অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

এডিবির অন্যান্য শর্তের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ও এর সাবসিডিয়ারি কোম্পানির সমন্বিত আর্থিক প্রতিবেদন অধিকতর কার্যকরভাবে প্রণয়ন করা। এ জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৩৮(৪) ধারায় ব্যাংকের এককভাবে আর্থিক প্রতিবেদন ও সাবসিডিয়ারিসহ সমন্বিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি এসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এর সঙ্গে আরো ১৩টি শর্ত জুড়ে দিয়েছে এডিবি। যেগুলো প্রথম ধাপের শর্ত পরিপালনের ১৫ মাসের মধ্যে কার্যকর করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে এসইসি ব্রোকারেজ হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকের মূলধন বাড়ানোর জন্য যে রিস্ক বেজড পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। শেয়ারবাজারে নজরদারি বাড়াতে ও বিভিন্ন সমন্বয় প্রক্রিয়ার বৈঠকে মার্কেট সার্ভিলেন্স সিস্টেমের প্রতিবেদন ব্যবহার করতে হবে। সংসদে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফআরএ) বিল উত্থাপন করতে হবে। যেখানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি), ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ডস ও ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অব অডিটিং (আইএসএ) প্রণয়ন করতে হবে। সনদপ্রাপ্ত নিরীক্ষক ও অ্যাকাউন্ট্যান্ট নিয়োগ প্রদান ও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য একটি স্বাধীন ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।

শর্তের মধ্যে রয়েছে আইপিও প্রিমিয়ামের ওপর যে ৩ শতাংশ আয়কর ধার্য করা হয়েছে, তা প্রত্যাহার করতে হবে। এসইসিকে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের নীতিমালা আরো সহজ করতে হবে। কোন ধরনের বিনিয়োগকারী প্রাইভেট প্লেসমেন্ট ক্রয় করতে পারবেন তা উল্লেখ করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এসইসিকে করপোরেট বন্ডের অনুমোদন দিতে হবে।

এ ছাড়া আয়কর অধ্যাদেশের ৫৩ (বিবিবি) ধারা পরিবর্তন করে বন্ডের লেনদেনে কর অব্যাহতির কথা বলা হয়েছে। যদি কোনো কোম্পানির দেনাদার ‘স্পেশাল পারপাস ভেহিকেল’ (এসপিভি) কাছে বিক্রি করা হয় তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্ট্যাম্প অ্যাক্ট ১৮৯৯ অনুসারে যে স্ট্যাম্প ডিউটি প্রদান করতে হয় তা অব্যাহতি দিতে হবে। এ ছাড়া প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে যেসব ডেট ইন্সট্রুমেন্ট বিক্রি করা হবে তাও স্ট্যাম্প ডিউটি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সরকার বন্ড বা সিকিউরিটিজ বাজারে ছাড়তে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা ১০ শতাংশের বেশি কমাতে পারবে না।

আইসিবি ওপেন-এন্ড মিউচুয়াল ফান্ডের ওপর যে কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা বেসরকারি ওপেন-এন্ড মিউচুয়াল ফান্ডের বেলায়ও দিতে হবে। এ ছাড়া ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ) অ্যাক্ট ২০১০ সংশোধন করতে হবে। যেখানে বীমা কোম্পানির পুনর্মূলধন ও বিনিয়োগ নীতিমালার জন্য আইডিআরএকে বিভিন্ন নীতিমালা ও নির্দেশনা জারির জন্য অফিশিয়াল গেজেট নোটিফিকেশন ইস্যুর ক্ষমতা দিতে হবে।

এডিবির শর্তানুযায়ী সব শেষে এসইসি মিউচুয়াল ফান্ড নীতিমালা ২০০১-এ মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপকদের আরো বিনিয়োগ স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
তবে এসব প্রস্তাব দীর্ঘমেয়াদে বাজারে সুফল বয়ে আনতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। তাদের মতে, এডিবির প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক মানদ- মেনে বাজার পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। এসইসিতে কারিগরিভাবে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ একটি টিম গঠনের প্রস্তাবও করা হয়েছে। বাজারের জন্য এটি ভালো একটি প্রস্তাব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

তাদের মতে, সব প্রস্তাব একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ধাপে ধাপে এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। বাজারের স্থিতিশীলতার বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে।