পুঁজিবাজারে কারসাজি তদন্তে গঠিত কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। রিপোর্টে বাজারে উত্থান-পতন ও বিপর্যয়ের সঙ্গে ইস্যু ম্যানেজার, ইস্যুয়ার কোম্পানি, স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলার, চার্টার একাউন্টেন্ট, নামীদামি কোম্পানিসহ অনেকের জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। এর পাশাপাশি পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অদক্ষতা, কমিশন শক্তিশালী করা ও জনবল বাড়ানোসহ নানা সুপারিশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া শেয়ার বাজারের বিপর্যয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। পুঁজিবাজারের অস্থিরতার পেছনে কয়েকজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছে এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, এসব নাম এই মুহূর্তে প্রকাশ করা হবে না।মূলত, সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, শেয়ারের অভিহিত মূল্য পরিবর্তন, সরাসরি তালিকাভুক্তি, বুক বিল্ডিং পদ্ধতি, প্লেসমেন্ট-বাণিজ্য, বোনাস শেয়ার ইস্যুসহ নানাভাবে শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এবং ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “এবারের ঘটনা ‘৯৬ সালের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। তখন সাক্ষীর অভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এবার সব তথ্য প্রমাণ সিডিবিএলে (শেয়ার লেনদেনের কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার) আছে।”পুঁজিবাজারে ব্যাংকের অর্থায়ন তদনত্ম প্রতিবেদনে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ৰেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনৈতিক মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজারকে পৃথক রাখা বিশ্ব স্বীকৃত নীতি। ব্যাসেল নীতিগুলো এ বিষয়ে গুরম্নত্বারোপ করেছে। কারণ পুঁজিবাজারে নিজস্ব পুঁজি থাকবে। কিন্তু আমানত ব্যাংকের নিজস্ব অর্থ নয়, গ্রাহকের নিজস্ব টাকা। ব্যাংক ট্রাস্টির ভূমিকায় গ্রাহকের আমানত জমা রাখে। আমানতকারীর অনুমতি ছাড়া ব্যাংক এই অর্থ পুঁজিবাজারে খাটাতে পারে না। এ কারণে ভারত-পাকিসত্মান-শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং আইনে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগযোগ্য তহবিলকে ব্যাংকের ইকু্যয়িটির অনুপাতে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকিং আইনে আমানতের ১০ শতাংশ বিনিয়োগের অনুমতি রয়েছে_ যা প্রথাসিদ্ধ নয় এবং ব্যাংকের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকে মূল পুঁজির অনুপাতে হিসাবের ব্যবস্থা করা উচিত।
কোম্পানির সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন কারসাজির মাধ্যমে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সম্পদের অতি মূল্যায়ন করে শেয়ারবাজারকে প্রভাবিত করার প্রমাণ পেয়েছে তদনত্ম কমিটি। তদনত্ম প্রতিবেদনে লিবরা ইনফিউশন (৩৪৭২ শতাংশ), সোনালী অাঁশ (৬২৬ শতাংশ), রহিম টেঙ্টাইল (৫১৮ শতাংশ), বিডি থাই এলুমিনিয়াম (২৯৮ শতাংশ), অরিয়ন ইনফিউশন (৪১৩ শতাংশ), ওশন কন্টেইনার্স (২৯৬ শতাংশ), শাইনপুকুর সিরামিকসহ (১২০ শতাংশ) বিভিন্ন কোম্পানির অস্বাভাবিক হারে সম্পদ পুনর্মূল্যায়নের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ‘সার্ভেয়ার ইনস্টিটিউট’ নেই। এই সুযোগে কোম্পানিগুলো সম্পদের অতি মূল্যায়ন করে বাজার প্রভাবিত করছে। কোম্পানিগুলো ডেফারড ট্যাঙ্রে প্রভিশনও রাখে না। এসইসি এ ধরনের অতি মূল্যায়ন রোধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ কারণে সার্ভেয়ার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যনত্ম চার্টার্ড এ্যাকাউন্টদের সম্পদ মূল্যায়নের দায়িত্ব দেয়া উচিত। তবে মূল্যায়নকারী ও নিরীৰাকারী ভিন্ন দুই প্রতিষ্ঠান হতে হবে।
শেয়ারের অভিহিত মূল্য পরিবর্তন তদনত্ম কমিটির প্রতিবেদেন বলা হয়েছে, ১০০ টাকার শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা রূপানত্মর বাজারে মূল্যকে প্রভাবিত করেছে। বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের মানসিক ভ্রমজনিত। ১০০ টাকার শেয়ার ৮০০ টাকা হলে যতোটা মূল্যবৃদ্ধি মনে হয়, ১০ টাকার শেয়ার ৮০ টাকা হলে তেমনটা হয় না। এই সুযোগ গ্রহণ করে বাজারে তালিকাবুক্ত ৮১.৫ শতাংশ কোম্পানি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকায় রূপানত্মর করেছে। বাজারে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য এখনও যেসব কোম্পানির শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০০ টাকা রয়ে গেছে, তাদের স্বল্প সময়ের মধ্যে ১০ টাকায় রূপানত্মর করে সকল শেয়ারের একই (ইউনিফর্ম) অভিহিত মূল্য করা উচিত।
বিদেশে পাচার ও অন্যান্য কারসাজির মাধ্যমে ১৫ কোটি টাকা বিদেশে পাঠানোর তথ্য পেয়েছে তদনত্ম কমিটি। জেম গেস্নাবাল নামে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিডি থাই এলুমিনিয়ামের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট হয়ে এই টাকা বিদেশে পাঠায়।
প্রতিবেদনে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, পদ্ধতিটি ভালো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এটি অপপ্রয়োগ করা হয়েছে। এজন্য এ পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।
সামগ্রিক বিষয়ে কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সেকেন্ডারি মার্কেটে কারসাজির অনেক তথ্য পেয়েছি। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে পুঁজিবাজারের বিশাল ৰেত্রের সব কিছু তদনত্ম করা সম্ভব নয়। এ কারণে নিয়মিতভাবে তদনত্ম কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য এসইসিতে গোয়েন্দা বিভাগ চালুর সুপারিশ করা হয়েছে।