রমজান মাস আসতে বাকি মাত্র দুই সপ্তাহেরও কম সময়। ইফতারিতে যেসব পণ্য বেশি দরকার তা কিনতে ব্যাগ হাতে বাজারে ছুটছেন ক্রেতারা। এর ফলে মুদি দোকানগুলোতে বিকিকিনিও বেড়েছে অনেক। ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, বিভিন্ন প্রকার ডাল, পেঁয়াজ, খেজুর, আটা-ময়দা-বেসন ও মসলাজাতীয় পণ্যই বেশি বিক্রি হচ্ছে এখন। বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ রয়েছে প্রচুর। তারপরও দাম বেড়েই চলেছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ইচ্ছামতো দাম হাঁকাচ্ছেন বিক্রেতারা।
বাজারে খোলা এবং বোতলজাত উভয় প্রকার সয়াবিন তেলেরই সরবরাহ ব্যাপক রয়েছে। অথচ দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে পণ্যটির। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনে আবারও ২ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। আর খোলা সয়াবিন যে যেমন পারছেন ইচ্ছামতো দামে বিক্রি করছেন। পাইকারি বাজার কিংবা খুচরা বাজারের সব দোকানেই রয়েছে বস্তা বস্তা ছোলা। কিন্তু ইতোমধ্যেই দাম বেড়ে ১০০ টাকা হয়ে গেছে। সরকারের হাতে ১ লাখ ৭৫ হাজার টন চিনির মজুদ থাকায় এ পণ্যটির দাম এখনও কিছুটা কম আছে। তবে গত সপ্তাহে সরকার ন্যায্যমূল্যে প্রতিকেজি চিনি ৬০ টাকায় বিক্রি শুরু করায় বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। সরকার বেশি দামে বিক্রি শুরু করায় পাইকারি বাজারে বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা এবং খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা দাম বেড়েছে চিনির। মসুর ডালের দাম স্থিতিশীল থাকলেও বেড়েছে বুট ও খেসারির ডালের দাম। আটা-ময়দা-বেসনের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে প্রকারভেদে ১০ থেকে ১৫ টাকা। আর পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা। এছাড়া খেজুর, মুড়ি এবং বেগুনের দামও বাড়ছে।

ভোজ্যতেল : দেশে প্রতিমাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা ১ লাখ ২৫ হাজার টনের মতো। রজমান মাসে সে চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ২৫ হাজার টনে। এ মাসে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরকার এবং আমদানিকারকরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নেন বাড়তি মজুদের। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রমজান উপলক্ষে ৭ হাজার টন ভোজ্যতেল মজুদের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোজ্যতেলের মূল মজুদ থাকবে রিফাইনারি মিল মালিক ও আমদানিকারকদের হাতে। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ভোজ্যতেল আমদানিকারক দেশের শীর্ষ ৫ প্রতিষ্ঠানই গত তিন মাসে আমদানি করেছে প্রায় ৩ লাখ টন ভোজ্যতেল। যার সিংহভাগই রমজান মাসকে লক্ষ্য করে আনা। সুতরাং এবার রোজার আগে ভোজ্যতেলের মজুদ ভালোই আছে। পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিকেজি খোলা সয়াবিন মিল গেটে বিক্রি হচ্ছে ১১৬ থেকে ১১৮ টাকায়। পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৮০০ টাকা মণ বা ১২০ টাকা কেজি। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩২ টাকায়। আর বোতলজাত সয়াবিনের মধ্যে ১ লিটার ১৩৫, ২ লিটার ২৬৭ এবং ৫ লিটার বিক্রি হচ্ছে ৬৭০ টাকায়।
চিনি : রমজান মাসের চিনির চাহিদাও ২ লাখ টনের বেশি। এর মধ্যে কেবল চিনি খাদ্য শিল্প করপোরেশনের হাতেই মজুদ রয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার টন চিনি। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের হাতে এবার পর্যাপ্ত চিনি মজুদ থাকায় ব্যবসায়ীরা কোনো সিন্ডিকেট করার সাহস পাচ্ছেন না। এ কারণে গত বছর রোজার আগে চিনির দাম যেখানে ৮০ টাকায় ঠেকেছিল সেখানে এখন পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি চিনি ৪৮ থেকে ৪৯ টাকায় এবং খুচরা বাজারে ৫২ থেকে ৫৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে সরকার বাজার মূল্যের চেয়ে ৬ থেকে ৮ টাকা বাড়িয়ে ৬০ টাকায় বিক্রি শুরু করায় বাজারেও চিনির দাম বাড়তে শুরু করেছে। তারপরও এবার চিনির দাম ৬০ টাকার মধ্যেই থাকবে বলে জানান পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম খান।

ছোলা : রমজান মাসে ছোলার চাহিদা থাকে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন। এর মধ্যে টিসিবি আমদানি করছে দেড় হাজার টন। ইতোমধ্যে ছোলার দুটি চালান টিসিবির হাতে পৌঁছেছে। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত এপ্রিল, মে এবং জুন মাসে আমদানিকারকরা ছোলা আমদানি করেছে প্রায় ৯০ হাজার টনের মতো। সুতরাং রমজানের চাহিদার চেয়েও বেশি ছোলা এসেছে এবার দেশে। বাজারে গেলেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কোনো দোকানেই ছোলার সরবরাহে কোনো কমতি নেই। কিন্তু ইতোমধ্যেই ছোলার দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এক মাস আগেও ছোলার দাম ছিল ৬০ টাকা। এখন সবচেয়ে ভালো মানের ছোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়।

ডাল : মসুর ডালের চাহিদা বছরজুড়ে থাকলেও রমজান মাসে খেসারি ডালের চাহিদা বেশি বাড়ে। কারণ ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ পেঁয়াজু বানানো হয় বেশিরভাগই খেসারির ডালের বেসন দিয়ে। এ কারণে খেসারির ডালের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক। মাসখানেক আগেও খেসারির ডাল বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। অথচ বাজারে সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই পণ্যটির। এছাড়া বুটের ডালেরও দাম বেড়েছে অনেক।

আটা-ময়দা-বেসন : রমজান মাসে আটা-ময়দা-বেসন ছাড়া ইফতারির খুব কম পণ্যই তৈরি হয়। এ কারণে এসব পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এ কারণে রমজানের ঠিক আগ দিয়ে আটা-ময়দা-বেসনের দামও বেড়েছে। বাংলাদেশ আটা-ময়দা মিল মালিক সমিতির সভাপতি মতিউর রহমান জানান, এবার আটা-ময়দার মজুদ বেশ ভালো রয়েছে। বাজারে কোনো সঙ্কট হবে না। তবে শবেবরাতের কারণে আটা-ময়দার দাম কিছুটা বেড়ে গেছে। বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাইকারিতে বস্তাপ্রতি ১০০ এবং খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতিকেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে বাজারভেদে ৩২ থেকে ৩৬ টাকায়। আর ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়।

খেজুর : বছরের অন্য সময় বাজারে ২ থেকে ৩ প্রকারের খেজুর পাওয়া গেলেও এখন রমজানকে সমানে রেখে মিলছে ৯ থেকে ১০ প্রকারের খেজুর ও খোরমা। দামও রয়েছে দশ প্রকারের। একই সঙ্গে সামনে রোজার মাস থাকায় সব প্রকার খেজুরের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বাজারে এখন সবচেয়ে কম দামি খেজুর হচ্ছে বাংলা খেজুর (সবচেয়ে কম মূল্য হওয়ায় এ নাম দেওয়া হয়েছে)। বাংলা খেজুর বিক্রি হচ্ছে বাজারভেদে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। তাছাড়া মরিচা বা ধপাস খেজুর ৯৫-১০০, মদিনা খেজুর ১৭০-২৫০, বরই খেজুর ১৮০-২৫০, নাগাল খেজুর ১২০-৪৩০, ফরিদা খেজুর ২৫০-৩৫০, তিউনিশিয়ান খেজুর ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মসলা : মসলাজাতীয় পণ্যের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে লবঙ্গের। মসলা বিক্রেতারা জানান, মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে লবঙ্গের দাম কেজিপ্রতি ৮০০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকার স্থলে ২ হাজার টাকা। তাছাড়া অন্যান্য মসলার মধ্যে বাজারে প্রতিকেজি এলাচ ২২০০-২৩০০, দারুচিনি ২২০-২৫০, জিরা ৪০০-৫০০, গোলমরিচ ৬০০-৭০০, জায়ফল ১২০০-১৪০০, কালিজিরা ১৮০-২০০, পাঁচফোড়ন ৮৫-১০০, কাঠবাদাম ৭৫০-৮০০, কিশমিশ ৩৬০-৪০০, চিনাবাদাম ৮৫-১২০।

পেঁয়াজ : রমজান মাস যত ঘনিয়ে আসছে তত বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। দেশি এবং আমদানিকৃত উভয় প্রকার পেঁয়াজেরই দাম বাড়ছে বাজারে। গতকাল কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পাইকারি দোকানে প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়।

মুড়ি : রমজানে মুড়ির কদরও কম নয়। বিষয়টি মাথায় রেখে মুড়ি ব্যবসায়ীরাও শুরু করেছে সিন্ডিকেট। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন প্রকার মুড়িতে দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা। রোজা শুরুর আগে আরও বাড়বে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে মেশিনে ভাজা প্রতিকেজি মুড়ি বিক্রি হয়েছে ৬০-৬৫ টাকায়। আর হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকায়।

বেগুন : বেগুনি ছাড়া ইফতারিই যেন পূর্ণতা পায় না। এ কারণে প্রতি রোজায় বেগুনের দাম বাড়ে অস্বাভাবিক। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে এখনও বেগুন নাগালের মধ্যেই রয়েছে। গতকাল রাজধানীর বাজারগুলোতে লম্বা বেগুন বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় এবং গোল বেগুন বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়।