দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। ট্রাইব্যুনালে সাঈদী বলেন, আমি একজন নিরীহ মানুষ। আমার বিরুদ্ধে বিনা অপরাধে অন্যায়ভাবে, আক্রোশমূলকভাবে বিচার করা হলে দেশে আল্লাহর গজব নেমে আসবে।  সংশ্লিষ্টদের ওপর আল্লাহর লানত-অভিশাপ বর্ষিত হবে। আমি সেই গজব ও পতন দেখার জন্য অপেক্ষা করবো। আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা। আমি নির্দোষ, আমি নির্দোষ।

অন্যদিনের মতো গতকালও সকালে সাঈদীকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে পুরনো হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনালে হাজির করানো হয়। সাঈদীকে আদালত কক্ষে নেয়ার আগেই প্রসিকিউশন বিভাগের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান, সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি প্রমুখ উপস্থিত হন আদালতে। সাঈদীর পক্ষে মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আল আমীনসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী হাজির হন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। শুরুতে আদালত ডেইলি নিউ এজ পত্রিকায় ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে আদালত অবমাননার কারণ ব্যাখ্যা করতে নির্দেশ দেন। পরে ট্রাইব্যুনাল ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দেয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষের ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে দেয়া বিভিন্ন যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন। পরে সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ২০টি অভিযোগ পড়ে শোনান।

এর মধ্যে একাত্তরে ৩ হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, নয় জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগি্নসংযোগ, লুটপাট, ভাঙচুর এবং একশ থেকে দেড়শ হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে ধর্মান্তরে বাধ্য করার অভিযোগের কথা জানানো হয়।

পরে আদালত সাঈদীর কাছে জানতে চান, তিনি নির্দোষ না দোষী। এ সময় তিনি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত তার বিচার করা হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এ পর্যায়ে অভিযোগগুলো ইংরেজিতে পড়া শেষ হলে সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম অভিযোগগুলো বাংলায় পড়ার আবেদন করেন। তিনি আরও বলেন, সাঈদী আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করে তার পর বক্তব্য রাখবেন, তার আগে নয়। কিন্তু আদালত তখন তাকে বসতে বলেন। তিনি বসলে আদালত অভিযোগ বাংলায় পড়া শুরু করলে সাঈদী বলেন, ‘ইংরেজিতে যা বলা হয়েছে, তা আমি বুঝেছি।’
এর পর আদালত কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাঈদীকে প্রশ্ন করে_ বলুন, আপনি দোষী কি না? তখন সাঈদী বলেন, আমি আমার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই জানানোর পর তিনি কিছুক্ষণ বক্তব্য দিতে সুযোগ চেয়ে নেন আদালতের কাছ থেকে।

 সাঈদী প্রথমে ‘নাহ্‌মাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রসুলিহিল কারিম ওয়া আলা আলিহী ওয়া আসহাবিহী আজমাঈন আম্মাবাদ’ বলে তার বক্তব্য শুরু করেন। সাঈদী বলেন,  গ্রেপ্তারের পরই আমি বুঝতে পেরেছি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই আমাকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। আমি এ শতাব্দীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মিথ্যাচারের শিকার হয়েছি। তিনি বলেন, আমাকে যেদিন প্রথম এই ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়, সেদিন আপনি হজ করে এসে প্রথম কার্য দিবসে ট্রাইব্যুনালে আসেন। তখন আপনার মাথায় টুপি ছিল, চেহারায় নুরানি আভা খেলা করছিল। আমি আশা করেছিলাম আমার ওপর কোন অবিচার করা হবে না। কিন্তু দেখলাম প্রসিকিউশন আমার নাম বিকৃত করে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করছে। আমি আশা করেছিলাম আপনি তার প্রতিবাদ করবেন। আমার নাম বিকৃত না করার জন্য আপনি প্রসিকিউশনকে নির্দেশ দেবেন। কিন্তু দেখলাম আদেশ দেয়ার সময় আপনিও প্রসিকিউশনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমার নাম বিকৃত করলেন। সাঈদী বলেন, আমার সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, পার্লামেন্ট কোন জায়গায় ওই নাম আছে প্রসিকিউশন যে নামে আমাকে এখানে উপস্থাপন করেছে? কোরআনের সূরা হুজরাতের ১১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ  বলেছেন, ‘তোমরা কারও নাম বিকৃত করো না’। বুখারী, মুসলিম ও মেশকাতসহ সহিহ হাদিসগ্রন্থগুলোতে রয়েছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, হাশরের ময়দানে বিচারের দিনে যখন কোন ছায়া থাকবে না, তখন ন্যায়পরায়ণ বিচারকদের আল্লাহ তার আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন। সাঈদী বলেন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক যুগের বেশি সময় আমাকে নিয়ে কোন কথা হয়নি। ১৯৮০ সালে আমি জামায়াতে ইসলামীর মজলিসে শূরার সদস্য হওয়ার পর থেকেই আমাকে নিয়ে অভিযোগ ওঠে। ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে সরকার গঠন হয়, সেই সংসদে আমি ২০ মিনিটের বক্তব্য দিয়ে বলেছিলাম, আমি রাজাকার নই। ভারতীয় রাজাকাররাই আমাকে রাজাকার বলছে। আমার সে বক্তব্যের প্রতিবাদ করা হয়নি। সেই ২০ মিনিটের বক্তব্যের একটি কথাও এক্সপাঞ্জ করা হয়নি। তা আজও সংরক্ষিত রয়েছে। সাঈদী বলেন, আমি মানবতার বিরুদ্ধে নই, বরং গত ৫০ বছর ধরে আমি মানবতার পক্ষে কাজ করছি। রাজাকারদের নেতা হওয়া তো দূরের কথা আমি কখনও রাজাকারের সদস্যও ছিলাম না। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার বাদী মিথ্যা, সাক্ষী মিথ্যা। অভিযোগপত্রের প্রতিটি বাক্য ও শব্দ মিথ্যা। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা মিথ্যাচার করেছে, তাদের মনে আল্লাহর ভয় ছিল না, হাশরের ময়দানে রাসূলের (সা.) শাফায়াতের আশা ছিল না। তাদের পক্ষে এ জন্যই এধরনের মিথ্যাচার করা সম্ভব হয়েছে।’ এসময় সাঈদী পানি চান। পানি দেয়া হলে তিনি পানি পান করেন। পরে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে একদিনের জন্যও আমার কোন বৈঠক হয়নি। এক মিনিট বা এক সেকেন্ডের জন্যও বৈঠক হয়নি। আল কোরআনের সূরা ইব্রাহিমের ৪৬ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ওরা (কাফের-মুশরিকরা) ভীষণ ষড়যন্ত্র করেছিল, কিন্তু তা আগেই আল্লাহর কাছে লেখা ছিল। আর ওদের সে ষড়যন্ত্র এমন ছিল যে, তা বাস্তবায়িত হলে পর্বতসমূহ ঢলে পড়তো। সুতরাং এটি ভাবার কোন কারণ নেই যে, আল্লাহ তার রাসূলদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা ভঙ্গ করবেন।  বরং আল্লাহই বিজয়ী এবং চরম প্রতিশোধগ্রহণকারী।’ ট্রাইব্যুনালে সাঈদী বলেন, আমি একজন নিরীহ মানুষ। আমার বিরুদ্ধে বিনা অপরাধে অন্যায়ভাবে, আক্রোশমূলকভাবে বিচার করা হলে দেশে আল্লাহর গজব নেমে আসবে।  সংশ্লিষ্টদের ওপর আল্লাহর লানত-অভিশাপ বর্ষিত হবে। আমি সেই গজব ও পতন দেখার জন্য অপেক্ষা করবো। আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা। আমি নির্দোষ, আমি নির্দোষ। এসময় ট্রাইব্যুনালের এক সদস্য বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির বলেন, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে, এর মানে এই নয় যে, আপনি অপরাধী। অভিযোগ প্রমাণিত না হলে আপনাকে সসম্মানে মুক্তি দেয়া হবে।

 গত ১৪ জুলাই ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ১০ তারিখ নির্ধারণ করেন। কিন্তু সাঈদীর পক্ষ থেকে কয়েক দফা সময় নেয়ায় ২৪ আগস্ট প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন শুনানি ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি শেষে আসামিপক্ষের করা সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু ওইদিন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিডিও ক্লিপিং চেয়ে আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। ওইদিন আদালত ভিডিও ক্লিপিং সাঈদীর আইনজীবীদের দিতে প্রসিকিউশনকে নির্দেশ দিয়ে শুনানি ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করে ট্রাইব্যুনাল। ২১ সেপ্টেম্বর থেকে চার্জ গঠনের বিষয়ে আসামিপক্ষের বক্তব্য উপস্থাপন শুরু হয় যা ২৭ সেপ্টেম্বর শেষ হয়।  ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গত বছর সাঈদীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।