প্রতিবছর সেই একই দৃশ্য। একই অবয়ব। পত্রিকার পাতায় পাতায় মানুষের ভোগান্তি আর হাহাকারের ছবি। টেলিভিশনের পর্দায় বিড়ম্বনার খবর। ভুক্তভোগী, অসহায় মানুষের প্রশ্ন-বছরের পর বছর ধরে কি এমনই অবস্থা চলতে থাকবে? এ থেকে বের হওয়ার কি কোনো পথ নেই? একই সঙ্গে তাদের প্রশ্ন পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমনটি ঘটে?
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঈদে মানুষের বাড়ি ফেরা নিশ্চিত, নির্বিঘ্ন করতে এক রকম জিহাদ ঘোষণা করেছেন। তারপরও পরিস্থিতি তথৈবচ। যেদিন তিনি বললেন কোনো সড়কের অবস্থাই বেহাল নয়, সে দিনই খাদে পড়ে আটকে গেল বিলাসবহুল এক  যাত্রীবাহী বাস। জমে থাকা পানিতে হাবুডুবু খেতে হয়েছে মোটরসাইকেলসহ যাত্রীদের। ৯ আগস্ট এ ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। পুরো পরিস্থিতি নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী অন্য মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেছেন।  মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, সমালোচনা করুন। অপপ্রচার করবেন না। সামনে কঠিন পরীক্ষা, আপনাদের সহযোগিতায় পাস করতে চাই। ট্রেন ছাড়া দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই চলে গেছে বেসরকারি খাতে। এ সুযোগে
 সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে যা ইচ্ছা তা-ই করছে বাস আর লঞ্চ মালিকরা। ট্রেন এখনও সরকারের হাতে। তবে সেখানে কালো বিড়ালের অবস্থান সর্বগ্রাসী। কালো বিড়াল মারতে গিয়ে ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজেই ধরাশায়ী হয়েছেন। তার উত্তরাধিকার হয়ে ওবায়দুল কাদের চেষ্টা করছেন। তবে সাফল্যের ঘরে এখনও অঙ্কের যোগ হয়নি।
ঈদের সময় বাস কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যাতায়াতের জন্য এখনও বড় অবলম্বন লঞ্চ। এখানেও সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বেশি দাম দিয়েও ঈদের সময় লঞ্চের টিকেট পাওয়া যায় না। অনেক লঞ্চের ফিটনেস নেই। যাত্রীসেবার কোনো বালাই নেই। অধিক মুনাফাই লঞ্চ মালিকদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে। তাই অধিক যাত্রী নিয়ে মাঝেমধ্যেই লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হয়। তখন আনন্দ রূপ নেয় বিষাদে।
সরকারি পরিবহনের মধ্যে সবচেয়ে বড় যাতায়াত মাধ্যম ট্রেন। দুই ঈদকে ঘিরে সেখানেও ত্রাহি অবস্থা। মধ্যরাত থেকে মানুষ লাইন দিয়েও টিকেট পায় না। শামুক গতিতে লাইন আগায়। কাউন্টারের কাছে পৌঁছানোর আগেই খবর হয় টিকেট শেষ। অথচ দিনভর টিকেট পাওয়া যায় কালোবাজারিদের কাছ থেকে। ৭ আগস্ট যোগাযোগমন্ত্রী কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে অব্যবস্থার চূড়ান্ত দেখে এসেছেন। তার সামনে ক্ষুব্ধ মানুষ অভিযোগ করেছেন। তুলে ধরেছেন সব অনিয়মের চিত্র। মোবাইল ফোনে টিকেট নিশ্চিতের ঘোষণা থাকলেও তা পাওয়া যায়নি এবার। এক টিকেটপ্রত্যাশী মন্ত্রীকে জানিয়েছেন এ তথ্য। কোনো কাজ হয়নি। সকালে একটি টিকেট মিলবে, সেই ভরসায় কমলাপুর স্টেশনে সারা রাত জেগেছে অসংখ্য মানুষ। তারপরও তাদের টিকেট-ভাগ্যের শিকে ছিঁড়েনি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মানুষ। মন্ত্রী তাদের জন্য কিছুই করতে পারেননি। মন্ত্রীর নির্দেশ আর বাস্তব পরিস্থিতি উল্টোমুখী।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। সরকারের চতুর্থ বছর চলছে। দুই ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের জীবনে তার কোনো ছোঁয়া লাগেনি। এখনও বাস, ট্রেন আর লঞ্চের অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে, অধিক টাকা খরচ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের যেতে হয় প্রিয়জনের কাছে।
এখানেই শেষ নয়। অনিয়ন্ত্রিত, বেহাল যানজটের জন্য পথ যেন আর ফুরাতেই চায় না।  বগুড়ার বাবু স্ত্রী আর মেয়ে নিয়ে থাকেন ঢাকার উত্তরায়। মা আর ছোট ভাইবোনরা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। ছোট চাকরি, তাই ইচ্ছা থাকলেও দুই ঈদে বাড়ি যেতে পারেন না বাবু। তিনি বলেন,  উত্তরা থেকে  যাত্রা করে গতবার ২০ ঘণ্টা লেগেছে বগুড়ার সোনাতলা যেতে। অথচ সব ঠিক থাকলে মাত্র ৫ ঘণ্টার পথ এটা। তিনি বলেন, ঈদের সময় সব এলোমেলো হয়ে যায়। হাইওয়েতে কোনো পুলিশ দেখা যায় না। কোথায় কেন গাড়ি আটকে আছে কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। পথের মধ্যে আটকা পড়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় নারী আর শিশুদের।
ঈদের সময় ঘরে ফেরা এবং ঢাকায় আসার পথে যানজট একটি নিত্য ঘটনা। তারপরও এবার মহাসড়কের যে পরিস্থিতি-ঘাটে ঘাটে মানুষকে পড়তে হবে মহাবিপাকে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য যাত্রাবাড়ী একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। যাত্রাবাড়ীর যানজটের ঐতিহ্য পুরনো। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের অনুষঙ্গ। সব মিলিয়ে সেখানে এখন ত্রাহি অবস্থা। তাই ওবায়দুল কাদেরের সাফ সাফ আত্মপক্ষ সমর্থন-‘যাত্রাবাড়ীর যানজটের দায় আমি নেব না।’
ঘরে ফেরা এবং ঢাকায় প্রত্যাবর্তনকারী মানুষের বিরক্তিকর প্রশ্ন তাহলে দায় কে নেবে? এভাবেই কি চলতে থাকবে সবকিছু। টিকেটের জন্য দীর্ঘ লাইন, পথের মধ্যে অনড় পড়ে থাকা। এভাবেই চলবে প্রতিদিন, প্রতিবছর? পথের ভোগান্তিতেই মাটি হয়ে যাবে সব আনন্দ?