হুমায়ূন আহমেদ আর নেই। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বাংলা সাহিত্যে তার অভাব ও শূন্যতা জাতি চিরকাল অনুভব করবে। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির বইমেলায় পুরো জাতি এ নন্দিত লেখকের শূন্যতা আরো তীব্রভাবে অনুভব করবে। তার বিদায় নেয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি সাহিত্য-নাটক ও সিনেমায় এক অতন্ত্র প্রহরীকে হারিয়েছে। এ মুত্যু পুরো জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ।

 

তার শূন্যতা জাতির সামনে ইতিহাস হয়ে থাকবে বলে বলে মত দিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও ধর্মের পাঠক।

 

বৃহস্পতিবার এ লেখকের চিরপ্রস্থানের পর তার বৈচিত্র্যময় জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের বার্তা২৪ ডটনেটের কাছে অভিমত প্রকাশের মধ্যে এ বক্তব্য ওঠে এসেছে।

 

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের নিয়মিত পাঠক ও পুরনো ঢাকার সিদ্দিক বাজারের পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ী হাজি আলাউদ্দিন হোসেন বলেন, ‘‘আমার ছেলের কাছ থেকেই এ লেখক সম্পর্কে সর্বপ্রথম অবগত হই। তার বইয়ে জীবনের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার সাবলীল বর্ণনা দেখেছি। তিনি অত্যন্ত রসবোধ সম্পন্ন লেখক ছিলেন। পুরো পরিবারকে নিয়ে পড়ার মতো অন্য লেখক আমি দেখি না। এ শূন্যতা ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে।”

 

ভিকারুন্নেনা নূন কলেজের শিক্ষক তাহমিদা খানম বলেন, ‘‘তার চলে যাওয়া প্রতিটি বাংলাদেশীর হৃদয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। তার মুত্যু সংবাদ শুনে আমার ছাত্রীরা হাউমাউ করে কেঁদেছে। এ যেন প্রিয়জন হারানোর বেদনায় শোকাপ্রকাশ। আমরা তার বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করছি। এমন আপনজন আমরা আর কোথায় পাবো?’’

 

শাস্তিনগরের বাসিন্দা ও বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা শিহাবউদ্দিন পলাশ বলেন, ‘‘স্কুল জীবন থেকে তার বই পড়া শুরু করেছি, পুরো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার উপন্যাস ছিল আমাদের পাঠানন্দের অন্যতম উৎস। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যকাশের দ্রুবতারা। তিনি ছিলেন প্রকৃত বাংলাদেশী অলরাউন্ডার।’’

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘‘সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে সাহিত্যের বহুমাত্রিক রূপ ও রস আস্বাদন করার সুযোগ আমার হয়েছে। পড়তে ও পড়াতে গিয়ে আমরা দেখেছি পশ্চিমা, আরবি, ভারতীয়, আফ্রিকান, পার্সিয়ান, সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্য ভৌগোলিক সীমানার সঙ্গে সঙ্গে এর ঘরানা, চরিত্র, জীবনযাত্রা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও ভিন্ন।’’

 

তিনি আরো বলেন, ‘‘সমকালীন বিশ্ব সাহিত্যের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই খুব কম উপন্যাসিকের লেখাই সীমানার উর্ধ্বে উঠতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সমকালীন বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসিক আবহ বাংলা সাহিত্যকে সীমানা ও কাল ও চরিত্র্যের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। তাকে বাংলা সাহিত্যের নির্ভেজাল, আধুনিক ত্রাতা বলা যায়। আমরা এমন জ্ঞানী লোক আবার কোথায় পাবো।’’

 

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবি’এর  ছাত্র তানভীর মাহমুদ বলেন, ‘‘বইয়ের প্রতি তরুণ সমাজের ঝোঁক ফেরানোর বেলায় হুমায়ূন আহমেদকে কোনো বাঙালি লেখকই পেছনে ফেলতে পারবে না। বইকে তিনি যুক সমাজের কাছে অবসরে আনন্দ লাভের হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।এটা তারকার পতন ছাড়া আর কিছু নয়।’’

 

শান্তিনগরের গৃহবধূ তাসলিমা হোসাইন (৩২) বলেন, ‘‘প্রতিবছর বই মেলা এলে আমরা হুমায়ূন আহমেদের বই কেনার জন্য লম্বা লাইন ধরে মেলায় যেতাম। প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কি উপেক্ষা করে তার বই কিনতে পারাকে আমরা আনন্দ হিসেবেই বিবেচনা করতাম। বই মেলায় তার আর কোনো নতুন বই পাবো না এটা ভাবতেই কষ্ট লাগে। এ মুত্যু প্রিয়জন হারানোর মতোই কষ্টকর।’’

 

গণপূর্ত বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী অমল কান্তি দাস (৫৩) বলেন, ‘‘ছেলে মেয়েদের তার বই কিনে দেয়ার জন্য প্রতিবছর একুশের বই মেলায় সপরিবারে যেতাম। আর হয়তো ছেলে মেয়েরা তার বই কেনার বায়না ধরবে না, আমারও আর হয়তো বই মেলায় যাবো না। এ শূন্যতা পূরণীয় নয়।’’

 

শাহবাগ থানার পুলিশ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন,  ‘‘লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের বই সম্ভবত পুরো বাঙালি জাতিকে এক সূতায় বাঁধতে সক্ষম হয়েছে। এর আগে এ কাজে শরৎচন্দ্র কিছুটা সফল হলেও অন্য কারো সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদকে তুলনা করা যাবে না। তার শূন্যতা বাঙালিকে দীর্ঘদিন অনুভব করতে হবে।’’

 

জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া স্টাডিস বিভাগের ছাত্রী ফাহিমা তুনতুন বলেন, ‘‘তার উপন্যাস তার জীবনের মতোই বৈচিত্র্যয়। একজন মানুষ যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফল হতে পারে তার প্রমাণ হলো হুমায়ূন স্যার। তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রেরণার উৎস হয়ে যুগ যুগ ধরে আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। তার এতো তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া মেনে নেয়া যায় না।’’

 

বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আমিন আহমেদ বলেন, ‘‘তিনি চলে গিয়ে আমাদের নি:সঙ্গ করে গিয়েছেন। এমন চলে যাওয়া আমরা কামনা করিনি। কিভাবে সফলতা অর্জন করতে হয় তিনি আমাদের তা শিখিয়ে গেছেন। সৃষ্টিশীল কর্মে তিনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন।’’