জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষণ দিয়েছেন। এটি উপস্থাপন করে তিনি বলেন ‘জনগণের ক্ষমতায়ন এবং শান্তিকেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেল’ শিরোনামে এ মডেলের মূল বিষয় হচ্ছে সব মানুষকে সমান চোখে দেখা এবং মানবিক সামর্থ্য উন্নয়নের কাজে লাগানো। একমাত্র শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
শেখ হাসিনা বলেন, আমার সারাজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি আপনাদের সামনে একটি শান্তির মডেল উপস্থাপন করতে চাই। এটি একটি বহুমাত্রিক ধারণা, যেখানে গণতন্ত্র এবং উন্নয়নকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়া হয়েছে। এতে ৬টি পরস্পর ক্রিয়াশীল বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এগুলো হচ্ছে (১) ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ, (২) বৈষম্য দূরীকরণ, (৩) বঞ্চনার লাঘব, (৪) ঝরেপড়া মানুষদের সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তি, (৫) মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং (৬) সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ মডেলের মূল বিষয় হচ্ছে সকল মানুষকে সমান চোখে দেখা এবং মানবিক সামর্থ্য উন্নয়নের কাজে লাগানো। একমাত্র শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব।শেখ হাসিনা বলেন, আসুন প্রয়োগ করে দেখি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এর মাধ্যমে সাত বিলিয়ন মানুষের এই বিশ্বকে আমরা পাল্টে দিতে পারবো। এমন একটি বিশ্ব গড়তে সক্ষম হব যেখানে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এছাড়া বিশ্ব মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র দক্ষিণ সুদানকে জাতিসংঘের ১৯৩তম সদস্য হিসেবে স্বাগত জানান শেখ হাসিনা।প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তিই হচ্ছে উন্নয়নের সোপান। আর শান্তি তখনই বিরাজ করে, যখন ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়। এজন্য আমি মনে করি শান্তিপূর্ণ মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য স্বদেশে এবং বিদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তা রক্ষাই এখন জাতিসংঘের প্রধান কাজ নয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আন্তঃরাষ্ট্র জাতিগত সংঘাত নিরসন, সন্ত্রাসবাদ দমন, আন্তঃসীমানা অপরাধ দমন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলা, দারিদ্র্য বিমোচন, পানি ও জ্বালানি নিরাপত্তা তৈরি এবং ধনী ও গরিবের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য বিলোপও জাতিসংঘের অন্যতম দায়িত্বের আওতায় এসেছে। তিনি আরও বলেন, এসব বিষয়ে জাতিসংঘের সাফল্যে একবিংশ শতাব্দীতে মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সবার সম্মিলিত ইচ্ছাকে আরও জোরদার করার মতো সক্ষমতা সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত ও বৈধ একমাত্র আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘেরই রয়েছে।শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের মধ্যস্থতা সম্পর্কিত সনদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মি. বান কি মুনের ‘মধ্যস্থতা এবং সহায়ক কার্যক্রম বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রতিবেদনের ভূয়সী প্রশংসা করছে। পাশাপাশি আমরা সাধারণ অধিবেশনের ‘বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিতে মধ্যস্থতার ভূমিকাকে শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক সিদ্ধান্তের সহউদ্যোক্তা হয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন,জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে ৩৬টি দেশের ৫২টি মিশনে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত এক লাখ ২২ হাজার ৯৪ জন শান্তিরক্ষী প্রেরণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের ১০৩ জন শান্তিরক্ষী শহীদ হয়েছেন। জাতিসংঘের শান্তি স্থাপন কমিশনে সমন্বয়কারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবসময়ই সংঘাত-পরবর্তী সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন এবং প্রতিকারমূলক কূটনীতির পক্ষে অভিমত দিয়ে আসছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি পরিকল্পনা এবং কৌশল প্রণয়ন পর্যায়ে বাংলাদেশের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব না থাকায় দুঃখ প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববাসীকে আরো বলেন, গত অর্ধশতাব্দী ধরে আমি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছি। পুরো সময়জুড়ে আমি ছিলাম শান্তির পক্ষে একজন অগ্রণী ও নির্ভীক যোদ্ধা। আমি মনে করি জবরদস্তি এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতির মতো অবিচার নিরসনের মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অসাম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বঞ্চনা, দারিদ্র্য, সামপ্রদায়িকতা, নারী এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকারহীনতা এবং সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। জাতীয় সংসদে ৬৪ জন এবং স্থানীয় সরকার পরিষদের সংরক্ষিত আসনে ১২ হাজার ৮২৮ জন নারী নির্বাচিত হয়েছেন। মন্ত্রিসভায় ৫ জন নারী সদস্য রয়েছেন, যারা কৃষি, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, শ্রম ও জনশক্তি এবং নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। আমি নিজে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও বিরোধী দলের নেতা, সংসদ উপনেতা এবং জাতীয় সংসদের একজন হুইপ নারী। এই প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদের দু’টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারপারসন হয়েছেন দু’জন নারী। উচ্চ আদালত, সামরিক-বেসামরিক এবং পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদে অনেক নারী সদস্য যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমেও আমাদের অনেক নারী সদস্য রয়েছেন। নারী উদ্যোক্তারা এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা একটি জরুরি অনুষঙ্গ। প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১১ হাজার কেন্দ্র থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি শিশুদের অটিজম এবং উবাবষড়ঢ়সবহঃ উরংড়ৎফবৎ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরির ব্যাপারে কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে গত জুলাই মাসে আমরা ঢাকায় গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ ইনিশিয়েটিভ উদ্বোধন করেছি। দোহা রাউন্ডের সফল সমাপ্তির জন্য মন্টেরি, প্যারিস এবং ব্রাসেলসে উন্নয়ন সহযোগীরা যেসব অঙ্গীকার করেছে, তা বাস্তবায়নের এখনই উপযুক্ত সময়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের জন্য এই ধরনের সহায়তার নিশ্চয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেলে আমাদের এক-পঞ্চমাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। এর ফলে ৩০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়বে। এমনটি হলে তা হবে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয়। এর আওতায় নদী খনন, শতকরা ২০ ভাগ ভূমির বনায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম ফসলের জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে ৩শ’ মিলিয়ন ইউএস ডলারের ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি। এ ছাড়া দাতাদের সহযোগিতায় একশ’ মিলিয়ন ইউএস ডলারের ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলেন্স ফান্ড প্রতিষ্ঠা করেছি।
বিশ্বের প্রায় ৩শ’ মিলিয়ন মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমি বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষার মর্যাদা দিতে আমাদের আবেদনের প্রতি সবার সমর্থন কামনা করছি।
