দেশের নয়টি সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকদের জন্য চাকরিবিধির নতুন খসড়া তৈরি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে প্রথমে তৈরি চাকরিবিধির খসড়ায় থাকা শিক্ষকদের প্রভিডেন্ড ফান্ড, উত্সব ও চিকিত্সা ভাতা, পেনশন, গ্র্যাচুইটি ও গ্রুপ বীমাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতাও কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির হাতে দেওয়া হয়েছে। কলেজগুলোর মধ্যে নিজ বা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় শিক্ষকদের বদলির বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।
এসব কারণে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও চাকরিবিধির আওতায় যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলেও হতাশ কলেজগুলোর শিক্ষকরা। নতুন খসড়া চূড়ান্ত করা হলে আইনি লড়াইসহ কঠোর আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। তাদের দাবি, প্রথম চাকরিবিধির খসড়াটিই চূড়ান্ত করা হোক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষার উন্নত পরিবেশ ও যুগোপযোগী গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব পূরণ করতে সরকার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অধীনে ১৯৯৭ সালে ঢাকা মহানগরীতে পাঁচটি ও ঢাকার বাইরে ছয়টি বিভাগীয় শহরে একটি করে মোট ১১টি বিদ্যালয় প্রায় ১১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়। ‘ঢাকা মহানগরীসহ ছয়টি বিভাগে ১১টি উচ্চ মাধ্যমিক মডেল বিদ্যালয় (বেসরকারি) স্থাপন প্রকল্প’ নামের এ প্রকল্পের অধীনে এসব বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ ২০০৬ সালে শেষ হয়। এসব কলেজ ২০০৭ সাল থেকে একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। পরবর্তী সময় দুটি কলেজ সরকার নিজের অধীনে নিয়ে নেয়। এর দু’বছর পর ২০০৯ সালে প্রকল্প পরিচালক সারোয়ার খান ও তত্কালীন মাউশির মহাপরিচালক আওরঙ্গজেব একটি চাকরিবিধি প্রণয়ন করেন এবং তা আইন মন্ত্রণালয় থেকে আইনি যাচাই বা ভেটিং করে আনা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময় সে বিধিটি আর
জারি করা হয়নি। এ বছর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি নতুন করে চাকরিবিধির খসড়া তৈরি করে। কমিটির সদস্যরা জানান, প্রথম চাকরিবিধির খসড়াটি ইংরেজিতে প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেই বিধির আলোকেই বর্তমানে বাংলায় নতুন করে মডেল কলেজের শিক্ষকদের জন্য খসড়া চাকরিবিধিটি করা হয়েছে।
নয়টি মডেল কলেজের মধ্যে রাজধানীর রয়েছে চারটি। এগুলো হল-মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, লালবাগ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রূপনগর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও শ্যামপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। আর ঢাকার বাইরে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীতে একটি করে মোট ছয়টি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপন করা হয়।
বর্তমানে রাজধানীর চারটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি শিক্ষা সচিব। কমিটির সদস্যদের মধ্যে আছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব ও দু’জন অভিভাবক প্রতিনিধি। সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ। রাজধানীর বাইরের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনার।
দুটি চাকরিবিধির খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগের খসড়া বিধিতে প্রতি কার্য বছর থেকে তিন মাস করে সর্বশেষ মূল বেতনের সমান হারে গ্র্যাচুইটি পাওয়ার কথা বলা আছে। নতুন খসড়ায় তা কমিয়ে প্রতি কার্য বছরের জন্য এক মাস হারে সর্বশেষ মূল বেতন গ্র্যাচুইটি হিসেবে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আগের বিধিতে উল্লেখ থাকা সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী পেনশন পাওয়ার বিষয়টি নতুন খসড়ায় উল্লেখ করা হয়নি।
আগের বিধিতে উল্লেখ করা মূল বেতনের ১০ ভাগ কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভবিষ্যত্ তহবিল নতুন খসড়ায় কমিয়ে ৮.৩৩ ভাগ করা হয়েছে। অথচ চাকরিতে যোগদানের পর থেকে ১০ ভাগ হারে কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড পেয়ে আসছেন শিক্ষকরা। একইভাবে শিক্ষকরা উত্সব ভাতাও ভোগ করে আসছেন। কিন্তু নতুন বিধির খসড়ায় এ ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। চিকিত্সা ভাতা জাতীয় বেতন স্কেল ২০০৯ অনুসারে সব শিক্ষক-কর্মচারী ৭০০ টাকা করে পেয়ে এলেও নতুন বিধিতে তা কমিয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে।
নতুন বিধিতি বিশেষ ভাতা সর্বোচ্চ দুটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। চাকরিকালীন সময়ে কোনো শিক্ষকের মৃত্যু বা চাকরি করতে অসমর্থ হয়ে পড়লে তাদের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার কথা আগের বিধিতে বলা হলেও নতুন বিধিতে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। আগের বিধিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তার প্রয়োজনে এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ চার লাখ টাকা পর্যন্ত বিনা শর্তে দেওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। নতুন খসড়ায় এ ব্যাপারে বীমা প্রিমিয়ামের মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারীদের জমাকৃত নিজস্ব অর্থ থেকে বীমা কোম্পানির মাধ্যমে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষকদের মতে, বর্তমানে বাজার দর ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তা আরও বেশি হওয়ার কথা ছিল। আগের বিধিতে উল্লেখ থাকা গ্রুপ বীমার বিষয়টিও নতুন বিধিতে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নতুন বিধির খসড়ায় আয় ও ব্যয়ের দায়িত্ব শুধু অধ্যক্ষের ওপর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে অর্থ সাব কমিটির তত্ত্বাবধানে বিভাগীয় কমিশনার ও অধ্যক্ষের যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশ মডেল কলেজ শিক্ষক-কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামান সকালের খবরকে বলেন, নতুন চাকরিবিধির খসড়া আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। এটা চূড়ান্ত করা হলে আমরা আইনি সহায়তা নেব। আন্দোলনে নামব।
সমিতির নেতৃবৃন্দ বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, যতদিন নতুন চাকরিবিধি না হয় ততদিন প্রয়োজনে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারবেন। এ সুযোগে গত কয়েক বছরে সব অধ্যক্ষই স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির পরিচয় দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ শিক্ষকদের। সমিতির হিসাব অনুযায়ী, মোহাম্মদপুর ১৪, লালবাগ ২০, শ্যামপুর ১০ জন, রূপনগর ২৪, রাজশাহী ৩৭, সিলেট ১৫, চট্টগ্রাম ৮, বরিশাল ১০ ও খুলনা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১৪ জন খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
মডেল কলেজগুলোর প্রথম নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা বলেন, প্রথম দফায় শিক্ষক নিয়োগের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী কমপক্ষে দুটি প্রথম শ্রেণী এবং শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার সার্টিফিকেট অবশ্যই অর্জন করতে হয়েছে। কিন্তু খণ্ডকালীন নিয়োগ দেওয়া শিক্ষকদের বেশিরভাগেরই এসব যোগ্যতা নেই। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে গভর্নিং বডির হাতে এ নিয়োগ ক্ষমতা দেওয়া হলে এতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে যোগ্য শিক্ষকের অভাবে মানসম্মত শিক্ষা ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
শিক্ষকরা দাবি জানিয়েছেন, আগের যোগ্যতা অনুযায়ী সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, শিক্ষকদের পেশাগত পদোন্নতি অধ্যাপক পর্যন্ত বহাল, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অভিজ্ঞ নিজস্ব অধ্যক্ষ নিয়োগ, গভর্নিং বডিতে দু’জন শিক্ষক প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা, নিয়োগপত্রের শর্ত মোতাবেক সব শিক্ষক-কর্মচারীর আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সরকারি নিয়মে দেওয়া ও নিজ এলাকার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বদলির সুযোগ রাখা।