প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের রূপরেখা বর্ণনা করে বলেছেন, চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরেই নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মধ্যে সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। আমরা পর্যায়ক্রমে সেতুর নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাব। একই সঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক আমাদের এ সেতু নির্মাণ কাজে দেরি করিয়ে দিয়ে যে ক্ষতি করেছে তার জন্য তাদের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হবে। এ ক্ষতি পূরণ চাইতে তিনি অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন।

তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। কারো কাছে মাথানত করিনি। করব না। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা কোথায় কি করে তাও খতিয়ে দেখা উচিত। বিশ্বব্যাংকের নিয়মিত অডিট হয় কি না তা জানতে চেয়ে তিনি বলেন, আমরাও বিশ্বব্যাংকের অংশীদার। তাদের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার অধিকার আমাদের রয়েছে।

গতকাল রোববার সংসদের ১৩তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার বক্তব্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থায়ন, সময়সীমা ও পরিকল্পনাসহ সার্বিক রূপরেখা সংসদে তুলে ধরেন। এ সময় সংসদ সদস্যরা তাদের বেতনের একটা অংশ পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সংসদে উপস্থিত ছিলেন না।

বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যখন দেশের উন্নয়নের কাজ করতে চাই তখনই তারা বাধা দেয়। এই দেশটাকে আমরা উন্নত করতে চাই। আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। আমাদের কেউ দান-খয়রাত করেনি। আমরা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এদেশ অর্জন করেছি।

স্বাধীনতার পর জাতির পিতা দেশের এবং জনগণের উন্নয়নের কাজ শুরু করেছিলেন। ‘৫ সালে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এরপরের ঘটনা সবার জানা। আমরা যখন ক্ষমতায় আসি আমাদের একটা চিন্তা মাথায় থাকে তা হল_ কীভাবে আমরা দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করব। প্রতি মুহূর্ত আমরা এ লক্ষ নিয়ে কাজ করি।

বিশ্বব্যাংক সামান্য অজুহাতে বাংলাদেশের ক্ষতি করেছে অভিযোগ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের উন্নয়নকে পিছিয়ে দেওয়া কোনো বাঙালি মেনে নিতে পারবে না। সেজন্য আমরা দাতাদের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের চিন্তাভাবনা করছি।

তিনি বলেন, ইতিমধ্যে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ করেছি। মূল সেতু নির্মাণে ১৫ হাজার কোটি টাকা, নদীশাসনে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকাসহ মোট ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা খরচ হবে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক আমাদের দেরি করিয়ে দেওয়ার জন্য খরচ বেড়ে গেছে। দেরি করানোর জন্য তাদের কাছে জরিমানা চাওয়া উচিত। এ সময় তিনি অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিশ্বব্যাংককে চিঠি লিখুন। তিনি বলেন, আমি আগেই বিশ্বব্যাংককে বলেছিলাম_ অভিযুক্ত কোম্পানি বাদ দিয়ে নতুন টেন্ডার দেন। তারা দেয়নি। কেন দেয়নি জানি না।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ইতিমধ্যে ১ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছি। সেখানে ৫৫ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেট। সেখান থেকে অনেক টাকা শর্টকাট করতে পারি। ওই শর্টকাটের টাকা দিয়ে আমরা পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে পারি। যেহেতু একসঙ্গে টাকা লাগছে না সেহেতু আমরা নিজস্ব অর্থায়ন দিয়েই পদ্মা সেতু করতে পারি। অনুন্নয়ন বাজেট কমানো সম্ভব নয়। এজন্য উন্নয়ন বাজেট থেকে আমরা ২৪ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারি। সেজন্য আমাদের কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। উন্নয়ন বাজেটের টাকা দিয়েই আমরা সেতুর কাজ শুরু করতে পারি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি_ অতি শিগগিরই আমরা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারব। এরমধ্যে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী আসতে চাইলে আমন্ত্রণ জানাব; কন্তু সময় ক্ষেপণ করব না।

পদ্মা সেতুর বিকল্প অর্থায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যে রেটিং দিয়েছে তাতে যে কোনো ধরনের বন্ড আমরা বাজারে ছাড়তে পারি। এবং এই বন্ড দিয়ে আমরা অনেক টাকা উপার্জন করতে পারি। ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করব। তাতে আমাদের বহু টাকা ওঠে আসবে। যমুনা সেতুর মতো আমদানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সারচার্জ প্রয়োগ করব। দেশের অভ্যন্তরেও বন্ড ছাড়তে পারি।

তিনি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন, আমরা কাজ শুরু করলে ১২/১৩ বছরে কি পরিমাণ টাকা লাগবে তার হিসাব করেছি। দেশীয় বন্ড থেকেও অর্থ সংগ্রহ করব। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ তহবিলে ৩ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। এ টাকাও খরচ করব। এ বিষয়ে জনগণের সমর্থন আছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমার দুটি টেলিফোন অনবরত বেছে যাচ্ছে। লাউড স্পিকার দিয়ে শুনছি। প্রবাসী বাঙালিরা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে শ্রমিকরা পর্যন্ত আমাকে বলেছে, আপা আপনি পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করেন। যত টাকা লাগে আমরা দেব। এখন যে টাকা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছি তার থেকে বেশি রেমিটেন্স পাঠাব। ছাত্রছাত্রীরা তাদের টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে পদ্মা সেতুর জন্য দিতে চেয়েছে। সারা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আমি যে চেতনা দেখেছি তাতে আমি আশাবাদী।

পদ্মা সেতু আমাদের অর্থায়নেই হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ_ যারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে তারা কখনো মাথা নত করেনি। মাথা নত করতে পারে না। তিনি বলেন, সারাদিন ফোন বাজছে। সব ফোন ধরতে পারি না। সম্ভব নয়। তবে ফোনের মাধ্যমে মানুষের কথায় যে সাহস ও সমর্থন পেয়েছি তাতে আমি দেশবাসীর কাছে কৃতজ্ঞ। তাদের সমর্থন সহযোগিতায় মনে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি যে চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল পদ্মা সেতুর জন্য আবার সেই চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু করতে হলে উন্নয়ন বাজেট থেকে কিছু কমাতে হবে। এরপরও আমরা উন্নয়ন করতে পারব। কারণ পদ্মা সেতু নির্মিত হলে আমাদের অর্থনীতিতে একটা প্রবৃদ্ধি রাখবে।

উন্নয়ন সহযোগীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, অহেতুক বাধা সৃষ্টি করে আমাদের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করবেন না। উন্নয়ন সহযোগীরা পাটশিল্প ধ্বংস করেছিল। কৃষিতে ভর্তুকি বন্ধ করতে বলেছিল। টিসিবিতে ভর্তুকি বন্ধ করতে বলেছিল। বিআরটিসি বন্ধ করতে বলেছিল। মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি বন্ধ করতে বলেছিল। আমরা তা মানিনি। মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার পক্ষে আমরা নই। উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের জনগণকে গিনিপিগ করে রাখতে চায়। ভিক্ষুক করে রাখতে চায়। কিন্তু আমরা তা চাই না। তা হবে না। আমরা ঋণ নিই। সুদসহ তা শোধ করে দেই। আমরা ভিখারি নই।

তিনি বলেন, যদি কোনো দুর্নীতি হয় আমি ক্ষমা করব না। যে-ই দুর্নীতি করুন, প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেব। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে আমি মন্ত্রী সরিয়ে দিয়েছি। সচিব সরিয়ে দিয়েছি। প্রকল্প পরিচালক সরিয়ে দিয়েছি। ঠিকভাবে যাতে তদন্ত করতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি। আমরা দেশের মানুষের কল্যাণ করতে চাই। ব্যক্তিগত ভাগ্য গড়তে আসিনি। বিএনপির মতো সব সময় লুটপাট করতে আসিনি। এ সময় তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারও আমার ওপর কুনজর দিয়েছিল। তারা তন্য তন্য করে খুঁজেছে। বিদেশে আমার কোনো টাকা পায়নি। আর বিদেশ তো আমার নতুন নয়।

অতীতে যখন বিদেশে ছিলাম তখনো তো বিদেশে টাকা রাখিনি। আমরা দেশের কাজ করি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নয়ন হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ে। কলকারখানার উৎপাদন বাড়ে। কিন্তু আমরা দাতাদের পরামর্শে চললে জীবনেও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে পারতাম না। বিএনপির যে নেতা আজ আমার বিরুদ্ধে কথা বলছেন সেই নেতা এবং তারা টাকা কোন দেশে রাখে সে তথ্য আমার কাছে আছে। বিএনপি নেতার প্রধানমন্ত্রী কালো টাকা সাদা করেছেন। বিএনপির অর্থমন্ত্রীও কালো টাকা সাদা করেছেন। মানিলন্ডারিংয়ের জন্য বিদেশ থেকে এফবিআই এসে সাক্ষ্য দিয়ে গেছে। তিনি বলেন, নিজেরা চোর বলে তারা সবাইকে চোর বলে। বিএনপির কোন নেতার টাকা কোথায় আছে তা শিগগিরই দেশবাসীকে জানানো হবে।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য আমি দেশবাসীর কাছ থেকে যে সাড়া ও সমর্থন পেয়েছি তাতে কৃতজ্ঞ। দেশবাসীর সমর্থন, আস্থা বিশ্বাসই আমার সম্বল। অনেক রক্ত এবং ত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই স্বাধীনতার সুফল জনগণের মধ্যে পেঁৗছে দেওয়ার জন্যই আমরা কাজ করছি। সে লক্ষ্যেই বাজেট প্রণয়ণ করা হয়েছে। প্রতি বছর আমরা বাজেট বৃদ্ধি এবং বাস্তবায়ন করছি। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কাজেই দেশটাকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বিশ্ব মন্দার মধ্যেও রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে। স্বাস্থ্য সেবা তৃণমূল পর্যায়ে পেঁৗছে দিয়েছি। ৪৫৮২টি ইউনিয়নে ইন্টারনেট সার্ভিস চালু করতে সক্ষম হয়েছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার শর্ত আমরা পূরণ করছি। ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রবাসীদের সঙ্গে সহজে কথা বলতে পারছেন। ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রে বসে বিদেশে অবস্থানরত স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা সফল হচ্ছি।

আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য আমরা কাজ করছি। প্রতি বছর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। যে কোনো আপৎকালীন বিপদ মোকাবিলার জন্য খাদ্য মজুদ আছে।
তিনি বলেন, আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি। লড়াই করেছি। জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যই আমাদের সংগ্রাম। সাড়ে ৩ বছরে ৫ হাজার ২০৩টি নির্বাচন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে নিজের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে। নির্বাচন কমিশন সমপূর্ণ স্বাধীনভাবে নির্বাচনগুলো পরিচালনা করেছে। ৭৫-এর পর ত্রাতা অবাধ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বাংলাদেশে হয়নি। এ পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ আসেনি। কাজেই আমরা যে জনগণের ভোটের অধিকার সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণ করতে পারি সেটা প্রমাণ করেছি। অর্থাৎ একটা দেশকে সার্বিকভাবে উন্নয়নের জন্য যে ধরনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত আমরা নির্বাচনী ইশতেহার অনুসারে সেই ব্যবস্থা করছি। এর সুফল দেশের মানুষ পাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা সরকার গঠনের পর যতগুলো কাজ করেছি কখনো কেউ কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি। দুর্ভাগ্যের বিষয় পদ্মা সেতুর বিষয়ে দুর্নীতির সম্ভাবনার কথা বলে পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করল। তাদের প্রকৃত দুর্নীতি হল_ যেখানে একটি পয়সাও তারা দেয়নি সেখানে দুর্নীতির অভিযোগ কিভাবে এল? তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের নিয়মিত অডিট হয় কিনা আমি জানি না। ওই ব্যাংকে যারা কাজ করে তাদের কার্যক্রম ঠিকমতো অডিট হয় কিনা আমরা জানি না। এটা জানা উচিত। কারণ আমরাও বিশ্বব্যাংকের অংশীদার। এজন্য সেখানে কি হচ্ছে তা জানার অধিকার আমাদের আছে।