বাজারে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে আকিজের ভেজাল ফার্মফ্রেশ পাস্তুরিত তরল দুধ। বারবার রাসায়নিক পরীক্ষা করেও এ দুধের শুদ্ধতা পাওয়া যায়নি।
এ দুধের উৎপাদক আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের প্রধান শেখ বশিরউদ্দীন আহমেদকে ভেজাল খাদ্য উৎপাদনকারী এবং রহিমআফরোজ কোম্পানির সিস্টার কনসার্ন আগোরার প্রধান নিয়াজ রহিমকে ভেজাল খাদ্য বিক্রয়ের অপরাধে দায়ী করেছেন বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত। এ অপরাধে দুজনকে আগামী ২৮ আগস্ট আদালতে হাজির হওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিন এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।
এদিকে, ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) ওপর দোষ চাপিয়েছে কোম্পানিটি। তারা বিশুদ্ধ খাদ্য আইনের মান ও পাবলিক অ্যানালিস্টের পরীক্ষণ সনদ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
২৩ জুলাই আদালতের নথিপত্রের ওপর ভিত্তি করে অনলাইন পত্রিকায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছে আকিজ। প্রতিবাদলিপিতে তারা উল্লেখ করেছে প্রকাশিত খবরে ফার্মফ্রেশ দুধ `জারে` বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু আদতে বাংলানিউজের প্রতিবেদনে কোথাও `জার` শব্দটি ছিল না। বরং আকিজের প্রতিবাদলিপিতে উল্লেখিত বক্তব্যের মতোই বলা হয়েছিল, পাস্তুরিত দুধ। প্যাকেটজাত। প্যাকেটের বর্ণনা ও প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল।
প্রতিবাদলিপিতে কোম্পানিটি উল্লেখ করে, তারা বিএসটিআইএর মান অনুযায়ী দুধ উৎপাদন করে। তারা বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশের সঙ্গে বিএসটিআইর মানের পার্থক্য রয়েছে বলে দাবি করেছে।
আকিজ ফুড তাদের বক্তব্যে জানিয়েছে, তারা বিএসটিআইর মান অনুযায়ী দুধ উৎপাদন করছে এবং এখন পর্যন্ত বিএসটিআইর কাছে তা ভেজাল প্রমাণিত হয়নি। তারা প্রশ্ন তুলেছে, তাদের নিয়ন্ত্রক আসলে কে, সিটি করপোরেশন নাকি বিএসটিআই? এক্ষেত্রে কোম্পানিটি পাবলিক অ্যানালিস্টের পরীক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। যদিও এটা পুরোপুরি রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের বিষয়।
আকিজ ফুড তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করেছে, পাবলিক অ্যানালিস্ট রাসায়নিক পরীক্ষায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ ফ্যাট পেয়েছেন যা সম্পূর্ণ অবাস্তব। পরীক্ষণাগারের সনদ সম্পর্কেও কোনো মন্তব্য নেই। কেননা, ১৯৬৭ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য বিধিতে খাদ্যমান পরীক্ষায় যে দুটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়া হয়, তার একটি ডিসিসির জনস্বাস্থ্য পরীক্ষণাগার, অন্যটি মহাখালির জনস্বাস্থ্য পরীক্ষণাগার। তাই এদের দায়ও নেবে প্রতিষ্ঠান ২টি। এছাড়া আকিজের ফার্মফ্রেশ দুধ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা করেও ভেজাল পাওয়া গেছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট দুপুর ১২টায় ৬৯ মগবাজারের আগোরা সুপার শপ থেকে আকিজ কোম্পানির ফার্মফ্রেশ ব্রান্ডের পাস্তুরিত তরল দুধ আলামত হিসেবে সংগ্রহ করেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নমুনা সংগ্রকারী কুটি মিয়া। তিনি আগোরার স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ ওয়াসিমের কাছ থেকে এ নমুনা সংগ্রহ করেন।
পরে ওই দুধ যথাব্যবস্থায় সংগ্রহ করে বেলা দেড়টার মধ্যে ডিসিসির জনস্বাস্থ্য পরীক্ষণাগারে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। পরীক্ষণাগারে রাসয়নিক পরীক্ষার পর ডিসিসির পাবলিক অ্যানালিস্ট গোলাম সারোয়ার ৩১ আগস্ট ২০১০ ডিসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মর্কতার কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তিনি ওই প্রতিবেদনে বিশুদ্ধ খাদ্যবিধি ১৯৬৭ অনুযায়ী পরীক্ষিত দুধ ভেজাল বলে সনদ প্রদান করেন।
ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান শেখ বশিরউদ্দীনকে ১ নম্বর আসামি ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়াজ রহিমকে ২ নম্বর আসামি করে বিশুদ্ধ খাদ্য আইন ১৯৫৯ (সংশোধিত ২০০৫) (৬)-এর (১) ও (৭) ধারায় আসামি করে মামলা করেন ডিসিসির ফুড অ্যান্ড স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ফখরুদ্দীর মোবারক। আদালতে দায়ের করা প্রসিকিউশনে তিনি উল্লেখ করেন, অভিযুক্ত আসামিরা বিশুদ্ধ খাদ্য আইনে ৪৪ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। পাবলিক অ্যানালিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী পরীক্ষিত দুধে আপেক্ষিক গুরুত্ব ১০২৮-১০৩২ এর স্থলে পাওয়া গেছে ১০৩০। দুগ্ধ চর্বি যেখানে থাকার কথা সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ সেখানে তা আছে মাত্র ২ শতাংশ ৫ শতাংশ। দুগ্ধচর্বিবিহীন দুগ্ধজাত কঠিন বস্তু থাকার কথা কমপক্ষে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ, অথচ আছে ২ দশমিক ২ শতাংশ। এতে বিশুদ্ধ খাদ্য বিধিমালা ১৯৬৭ মতে পরীক্ষিত পণ্যটি ভেজাল হিসেবে উৎপাদিত হয়েছে এবং বাজারজাত হয়েছে।
এরপর আসামি প্রতিষ্ঠান আদালতে ফ্রেশ দুধ সংগ্রহ করে তা পুনর্পরীক্ষার আবেদন জানায়। আদালত সে আবেদন মঞ্জুর করেন এ শর্তে যে আসামি পক্ষ এর সব ব্যয় বহন করবে। ২০১১ সালের ৪ মে এ নির্দেশ দেন। ১৫ মে ২০১১ সালে নমুনা সংগ্রহে নামেন আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ব্যবস্থাপক (বিক্রয়) ও সহ-ব্যবস্থাপক। ডিসিসির নমুনা সংগ্রহকারী কুটি মিয়া এবং ফুড অ্যান্ড স্যানিটেশন ইন্সপেক্টর ফখরুদ্দীন মোবারক। তারা ২৩৯ বড় মগবাজারের চিত্রাঙ্গন জেনারেল স্টোর থেকে ফার্মফ্রেশ পাস্তুরিত তরল দুধ আবারো সংগ্রহ করেন। তবে পুরো রমনায় ওই দিন দুধ সরবরাহ বন্ধ রেখেছিল আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ।
সংগৃহীত দুধ যথাযথ ব্যবস্থায় জমা দেওয়া হয় বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে। আদালত তা পুনর্পরীক্ষার জন্য পাঠান ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ডেইরি সায়েন্সের প্রধান প্রফেসর ড. হারুনুর রশীদের কাছে। এ পরীক্ষায় ও ফার্মফ্রেশ দুধটি ভেজাল প্রমাণিত হয়।
এরপরও আকিজ কোম্পানি আবারো পরীক্ষার আবেদন জানালে আদালত তা প্রত্যাখ্যান করে।
আদালতে গচ্ছিত ফার্মফ্রেশের প্যাকেটে দেখা যায়, ব্যাচ নাম্বার আছে। উৎপাদনের তারিখ আছে, কিন্তু নেই মেয়াদ উত্তীর্ণ তারিখ। প্যাকেটের জোড়ার নিচে লেখা আছে উৎপাদনের সাত দিনের মধ্যে ব্যবহার করা উত্তম। কিন্তু কথাটি এমন জায়গা লেখা আছে কোনো গ্রাহকেরই নজরে আসবে না। আগামী ২৮ আগাস্ট এ মামলার রায় ঘোষিত হবে। তবে কোম্পানিটি বলছে ওই দিন এ মামলার চার্জ গঠন করা হবে, রায় নয়।