গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ভিকারুননিসার মাঠে শিক্ষার্থীদের উল্লাস। নেচে গেয়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে এ উল্লাসের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। দুপুর ২টা ৪১ মিনিটে ফল প্রকাশের পর পরই কোন শিক্ষার্থীকে থামানো যায়নি। দৌড়ে গিয়ে বৃষ্টি ভেজা মাঠে ছোটাছুটি শুরু করেছে। জড়িয়ে ধরছে সতীর্থ আর সহপাঠীদের। নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি অভিভাবক আর শিক্ষকরা। চোখ মুখ থেকে তাদেরও ঠিকরে পড়েছে ভালোবাসার আলো, জয়ের আনন্দ।
হুররে…রে ধ্বনিতে হার মানে বৃষ্টির রুমঝুম শব্দ। চিৎকার আর আনন্দ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো সিদ্ধেশ্বরী এলাকা।
এবার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় মোট অংশ নেয় ১২৭৯ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ৯১১ জন জিপিএ৫ অর্জন করেছে। তবে বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। এ বিভাগে ৭৬৮ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করে ৭৬৮জন শিক্ষার্থী। এ বিভাগে জিপিএ৫ পায় ৬২৬ শিক্ষার্থী। বিজ্ঞানে পাসের হার ৯৯ দশমিক ২।
বাণিজ্যিক বিভাগে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২৭৮ জন। এ বিভাগে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। তবে জিপিএ৫ অর্জন করেছে ২১৫ জন। আর মানবিক বিভাগে ২৩৩ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ১ জন ছাড়া ২৩২ জনই পাস করেছে। মানবিকে জিপিএ-৫ অর্জন করে ৭০ জন শিক্ষার্থী। এ বিভাগে পাসের হার ৯৯ দশমিক ৬।
কেমন লাগছে জানতে চাইতে ‘এ আনন্দে প্রকাশের ভাষা নেই, পরে কথা বলবো’ বলেই দৌড়ে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো বন্ধুদের দলে। নাচতে নাচতে উল্লসিত শিক্ষার্থীরা কখন যে কাঁদা মাখামাখি হয়ে গেছে, সেদিকেও খেয়াল নেই তাদের। একে অপরকে জড়িয়ে ধরার এ আনন্দে যখনই নতুন কেউ যোগ দিচ্ছে, সেও হারিয়ে যাচ্ছে আনন্দ জোয়ারে।
বোর্ডে ফলাফল ঝোলানোর আগে অনেকেই রেজাল্ট জেনে যায় সেল ফোন আর ইন্টারনেট থেকে। বোর্ডের সামনে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষমান কারো কারো মোবাইলে যখন রেজাল্টের এসএমএস আসতে লাগলো তখন তারা চিৎকারে কাঁপিয়ে তুললো চারপাশ। পাশেই সহপাঠীর রেজাল্ট চলে আসতে দেখে অনেককে মন খারাপ করতেও দেখা যায়।
ফলাফল বোর্ডে ঝুলিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো সেখানে। বৃষ্টির সঙ্গে উল্লসিত শিক্ষার্থীদের সমাবেশের দৃশ্যটা নিমেষেই অন্যরকম হয়ে উঠলো। গলায় জড়িয়ে আনন্দের ভাগাভাগি, মোবাইলে প্রিয়জনদের কাছে খবর পৌঁছানো আর ক্যামেরার আলোয় ঝলকে উঠতে দেখা গেল সবাইকে।
যে অনুভূতি প্রকাশ করার মতো নয়
ফলাফল প্রকাশের পরপরই যখন কৃতি শিক্ষার্থীদের অনুভূতি শোনার জন্য সংবাদকর্মীরা ভিড় জমালেন, তখন তাদের মুখ থেকে উচ্ছ্বাসের ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই বের হয়নি। বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ৫ পাওয়া তাহসিনা আফরিন বাংলানিউজকে বলেন, “বলার কোনো ভাষা নেই। আসলে এই আনন্দের জন্যই এতোক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম।”
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপি৫ পেয়ে সাদিয়া আফরিনও একই অনুভূতি প্রকাশ করেন। বলেন, “কিছু বলার ভাষা নেই। অনেক ভালো লাগছে।”
রেজওয়ানা ইসলাম জিপিএ৫ পেয়েছেন মানবিক বিভাগ থেকে। বাংলানিউজকে তিনি জানান, “এই অনুভূতি প্রকাশ করার মতো নয়। এতো বেশি আনন্দ জীবনে কখনো পাইনি।”
অভিভাবকদের মুখেও একই কথা। তারাও যেন আনন্দ ধরে রাখতে পারছেন না। অনিন্দিতা আর সমাদৃতা নামে যমজ দুই শিক্ষার্থীর মা চোখের কোণায় আনন্দাশ্রু নিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, “সবচেয়ে বড় আনন্দ হচ্ছে আমি ওদের মা। প্রাসাদ কেনার চাইতেও বেশি খুশি লাগছে। কি করে যে বোঝাবো।”
সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা এমএ হালিম বলেন, “সব মেয়েগুলোকেই নিজের মেয়ের মতো মনে হচ্ছে। সবার এতো আনন্দ, কোথায় যে রাখি।”
আনন্দের মাঝেও একটুখানি কষ্ট
সহপাঠীরা যখন জিপিএ৫ পেয়ে আনন্দে উদ্বেল, তখন কারো কারো চোখে খেলা করছে কান্না। কলেজের দেয়াল ঘেঁষে অনবরত চোখ মুছতে দেখা গেছে অনেককেই। কেউ আবার বাবা কিংবা মায়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলছে, “এটা হতে পারে না, আমি এ রেজাল্ট মানি না।”
সোহানা নামে আরেক শিক্ষার্থীর মা বললেন, “মেয়ে জিপিএ৫ পাবে না, কখনো আশা করিনি। তবুও ভাগ্যের পরিহাস। সবাই যখন আনন্দ করছে, আমাদের তখন কান্না করা ছাড়া কোন উপায় নেই।”
লামিসা নামে এক শিক্ষার্থীর কান্নায় তার অভিভাবকও কেঁদে উঠলেন। বাংলানিউজকে তিনি জানালেন, “অনেক ভালো পড়াশোনা করেও জিপিএ৫ পায়নি। তাই খুব কষ্ট লাগছে।”
কোনো কোনো অভিভাবক আবার তাদের সন্তানদেরকে শান্ত্বনা দিতে দেখা গেছে। জিপিএ৫ না পাওয়ার এ বেদনায় এবার ভিকারুননিসায় অনেকেই কেঁদেছে।
ফলাফলে সন্তুষ্ট শিক্ষকরা
ভিকারুননিসা নূন কলেজের এ বছরের ফলাফলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জুআরা বেগমসহ অন্যান্য শিক্ষকরা। কলেজ অধ্যক্ষ জানান, “আমরা সন্তুষ্ট। গতবারেও আমরা বোর্ডে ৪র্থ স্থান অর্জন করেছি। এবারেও তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছি। এজন্য শিক্ষকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। শিক্ষার্থীরাও আমাকে কথা দিয়েছিল, তারা সে কথা রেখেছে।” ভবিষ্যতে আরো ভালো ফলাফল করার আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
শিক্ষকরাও জানালেন একই অনুভূতি। এমন ফলাফলে সবাই সন্তুষ্ট। তবে আরো ফলাফলে জন্য প্রত্যয়ী হতে হবে বলেও জানালেন তারা।