ট্রেনে টিকিট নেই। আর বাসে দ্বিগুণ ভাড়ার সঙ্গে লঞ্চেও দেখা দিয়েছে টিকিট সঙ্কট। টিকিট না পেয়ে লঞ্চের ছাদে চড়ে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে দক্ষিণাঞ্চলের হাজারওমানুষ।
লঞ্চের ছাদে চড়তে কর্তৃপক্ষের নিষেধ থাকলেও কেউ মানছে না সেই নির্দেশ। স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য সব ঝুঁকি নিতেই রাজি ঘরে ফেরা মানুষ।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। এই বৃষ্টি উপেক্ষা করে সদরঘাটে ঘরে ফেরা মানুষের ছিল সীমাহীন ভিড়। টার্মিনালের কোথাও তিল ধারনের ঠাঁই নেই। বৃদ্ধ ও শিশুদের নিয়ে অনেকেই পড়েছেন বিপাকে। বড় বড় লাগেজ নিয়ে বাড়ি ফেরা মানুষগুলোর ভোগান্তির শেষ নেই।
লঞ্চে টিকিট না পেয়ে অনেককেই চরম হতাশ হতে দেখা গেছে। অবশেষে কালোবাজারিদের কাছ থেকে দ্বিগুন দামে টিকেট নিতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রয়োজনের তুলনায় লঞ্চের ঘাটতি রয়েছে। লঞ্চ মালিকরা দাবি করছেন, দক্ষিণাঞ্চলের ৩০ লাখ লঞ্চযাত্রী রয়েছে। কেবিন, ডেক ও সোফা মিলিয়ে লঞ্চে এ পরিমাণ যাত্রী বহনের কোনো সুযোগ নেই। ফলে বাধ্য হয়েই যাত্রীরা লঞ্চের ছাদে চড়ছে। কর্তৃপক্ষের মানা তারা শুনছে না।
বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা ছাড়াও এসব জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঢাকা থেকে সরাসরি লঞ্চ চালু রয়েছে। এসব লঞ্চে কেবিন প্রত্যাশী যাত্রীর সংখ্যা ২৫ হাজারেরও বেশি। তবে তার বিপরীতে কেবিন রয়েছে মাত্র সাড়ে ৪ হাজার। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলোর মধ্যে বিলাসবহুল লঞ্চ মাত্র ১১টি।
এই লঞ্চগুলোতে যাত্রীদের চাহিদা অনেক বেশি থাকলেও সে চাহিদা পূরণ করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। জানা যায়, বিলাসবহুল ১১টি লঞ্চ মিলিয়ে সবক’টিতে কেবিন রয়েছে মাত্র ৯৩০টি। যা অনেক আগেই বুকিং হয়ে গেছে বলে লঞ্চ মালিক কর্তৃপক্ষ জানায়।
তবে লঞ্চের টিকিট কালোবাজারি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সদরঘাট টার্মিনালে আসা যাত্রীদের অনেকেই। বাংলানিউজকে তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘কাউন্টারে টিকিট নেই। সব টিকিট দালালদের কাছে। কয়েকগুণ বেশি দাম দিলেই টিকিট বেরিয়ে আসে। কর্তৃপক্ষ এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। আর মাঝখান থেকে আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়ছি।’
২৫ রমজান থেকে যাত্রীদের চাহিদা মেটাতে অনেক লঞ্চ প্রতিদিন ডবল ট্রিপ দিতে শুরু করেছে বলে জানান সুন্দরবন নেভিগেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমান।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘যে পরিমাণ যাত্রী, তাতে এতো অল্প লঞ্চে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তবুও বাড়ি ফিরতে হবে বলে মানুষ ঝুঁকি নিচ্ছে। তবে আমরা হাইকোর্টের রুল মেনে ছাদে যাত্রী তোলা ও কালোবাজারে টিকিট বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে সতর্ক আছি।’
শ্যামলী থেকে আসা নাজমুন নাহার ডলি টিকিট না পেয়ে ক্ষোভের সঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ‘এগুলো সব তাদের কারসাজি। টিকিট দালালদের কাছে দিয়ে আমাদের বলছে নেই।’
একই অভিযোগ অন্যান্য যাত্রীদেরও। নিশাত সুলতানা নামে এক যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, ‘টিকিট নেই বলে লঞ্চে তুলছে না। অথচ অনেকেই দেখি দালালদের কাছ থেকে টিকিট নিয়ে আসন দখল করে আছে। দুই তিনগুণ বেশি টাকা দিলে টিকিট ম্যানেজ হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
বরিশালের যাত্রী জয়নাল আবেদিন বাংলানিউজকে দ্বিগুণ দাম দিয়ে টিকেট কেনার অভিযোগ করে বলেন, ‘ডেকে বসে যাচ্ছি। কেবিন তো অনেক আগেই বুকিং হয়ে গেছে। এখানেও দাম দ্বিগুণ। তবুও যেতে হবে।’
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে কেবিনের যাত্রীদেরও বিস্তর অভিযোগ। তারাও টিকিটে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা গুনেছেন।
জিহাদুল ইসলাম নামে এক যাত্রী বাংলানিউজকে বলেন, ‘১২০০ টাকার কেবিন ২ হাজার টাকা দিয়ে নিয়েছি। দালালের কাছ থেকে এই কেবিন না নিলে বাড়ি যাওয়াই হতো না।’
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক যাত্রী লঞ্চের ছাদে চড়ে বাড়ি ফিরছে। ছাদে চড়া নিষেধ থাকলেও লঞ্চের কিছু অসাধু কর্মচারী যাত্রীদের ছাদে উঠতে সাহায্য করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছাদে বসেও দিতে হচ্ছে চড়া মূল্য।
নওয়াব আলী নামে এক যাত্রী বলেন, ‘জীবনে এই প্রথম লঞ্চের ছাদে করে যাচ্ছি। কিছুটা ভয় লাগলেও আনন্দ অনেক বেশি। লঞ্চের এক কর্মচারী আমাকে ছাদে উঠতে সাহায্য করেছে। কষ্ট হলেও বাড়ি তো যেতে পারছি।’
তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বৃদ্ধ ও শিশুদের নিয়ে বাড়ি ফেরা মানুষদের। মোকাররম হোসেন তার ৭০ বছর বয়সী মা’কে নিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে পড়েছেন বিপাকে। লঞ্চের কোথাও জায়গা না পেয়ে অবশেষে তাকেও ছাদে চড়তে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কী আর করা। বাড়ি তো যেতে হবে। তাই বাধ্য হয়েই এখানে বসেছি।’
জানা যায়, ছাদে চড়ে যাওয়া যাত্রীরা চাদর বিছিয়ে বসলে ভাড়ার সঙ্গে অতিরিক্ত ৭০ টাকা করে দিতে হয়। এসব টাকা লঞ্চের কর্মচারিরাই আদায় করছে। ডেক ও ছাদে কিছু অসাধু লো আগে থেকেই চাদর বিছিয়ে জায়গা দখল করে রাখছে বলে জানা যায়। যাত্রীরা এলে তাদের কাছ সে জায়গার বিনিময়ে টাকা আদায় করে নিচ্ছে এসব দালালরা।
তবে এমন অনিয়মের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন নৌযান পরিদর্শক আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যাত্রীদের নিরাপদ গন্তব্য নিশ্চিত করতে সতর্ক রয়েছি। সব ধরনের দালাল ও অসাধু লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। লোকজনের ভিড় বেশি থাকায় নিয়ম পালনে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। তবুও আমাদের চেষ্টার কমতি নেই।’