নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। প্রতিবেদনের বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিজিবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাটি বিডিআর বিদ্রোহের বিচার স্থগিত করার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। এ ঘটনায় তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছে।

গতকাল শুক্রবার বিজিবির মহাপরিচালকের পক্ষে জনসংযোগ কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। এতে বলা হয়, গত ৪ জুলাই ঢাকায় প্রেস ব্রিফিংয়ে বিডিআর বিদ্রোহের বিচার সম্পর্কিত মন্তব্য এবং প্রতিবেদন প্রকাশের বিষয়টি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দজশর অবগত হয়েছে। সংস্থার অবিবেচনাপ্রসূত অযৌক্তিক মন্তব্য এবং প্রতিবেদনের ভিত্তিহীন তথ্যাদি প্রকাশ সামগ্রিকভাবে বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

দেশের প্রচলিত আইন সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি, বিজিবির মতো একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্যদের নৈতিক মনোবলে আঘাত করা, আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা প্রদান, সর্বোপরি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে বিদ্রোহ ও জঘন্যতম হত্যাকা-ের বিচার স্থগিত করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বিজিবি সদর দফতর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যে অবর্ণণীয় নারকীয়তা এবং অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল তার বিচারে সুপ্রিমকোর্ট নির্দেশনা দেয়। হত্যা, অগি্নসংযোগ, লুট ইত্যাদি অপরাধের ক্ষেত্রে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায় এবং বিদ্রোহের অপরাধের ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ রাইফেলস অর্ডার, ১৯৭২’ এর আওতায় বিচার করার আদেশ দেওয়া হয়। সেই অনুসারে বিচার হচ্ছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, বিদ্রোহের মামলার জন্য সুপ্রিমকোর্টের আদেশের পর বিডিআরের বিভিন্ন স্থাপনায় ‘বাংলাদেশ রাইফেলস অর্ডার, ১৯৭২’ অনুযায়ী ১১টি বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। এসব আদালত পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ রাইফেলস অর্ডার, ১৯৭২’ এবং ‘বাংলাদেশ রাইফেলস রুলস, ১৯৭১’ যথাযথ অনুসরণ করা হয়। আইন অনুসারে বিচারের ক্ষেত্রে আসামিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়।

‘বাংলাদেশ রাইফেলস অর্ডার, ১৯৭২’-এর আর্টিকেল ১০ (৩) অনুসারে আসামি তার পক্ষে যে কোনো অফিসার অথবা আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন। সে জন্য আসামিদের সহায়তার জন্য বাহিনী থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। তা ছাড়া আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনে সহায়তা নিতে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবী নিয়োগ করে তাদের সহযোগিতাও গ্রহণ করেছেন।

এছাড়া ‘বাংলাদেশ রাইফেলস রুলস, ১৯৭১’-এর রুল ৩ অনুসারে আসামি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের একটি কপি পাওয়ার অধিকারী। সব বিশেষ আদালতে আসামিদেরকে তাদের গ্রেফতারের সময় অভিযোগের কপি এবং আদালতের আদেশের কপি হস্তান্তর করা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, একই আইন অনুযায়ী আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আগে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কমপক্ষে ২৭ দিন সময় দেওয়ার বিধান রয়েছে। সেখানে আদালত আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনে পর্যাপ্ত সময় দিয়ে কমপক্ষে ২৭ দিন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৬ মাসেরও বেশি সময় দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, আইন অনুযায়ী আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনে সাফাই সাক্ষী আনার অধিকারী। সে অনুযায়ী সব আসামিকে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনে সাফাই সাক্ষী উপস্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত সময় প্রদান করা হয়েছে। আরো বলা হয়,

আইন অনুযায়ী আসামিরা তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ এবং সাক্ষ্যসমূহ ব্যাখ্যা করে আদালতে বক্তব্য দেওয়ার অধিকারী। সে অনুযায়ী প্রতিটি বিশেষ আদালতে প্রত্যেক আসামি তার বক্তব্য এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আনুষঙ্গিক নথিপত্রাদিসহ লিখিতভাবে আদালতে উপস্থাপন করেছেন। আদালত এই বক্তব্য দেওয়ার জন্য আসামিদের পর্যাপ্ত সময়, প্রয়োজনীয় কাগজ-কলম এবং অন্যান্য সুবিধাদি প্রদান করেছেন।

বিদ্রোহের অপরাধের আসামিদের গ্রেফতারপূর্বক সরাসরি অসামরিক কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া হত্যা, অগি্নসংযোগ, লুট ইত্যাদি অপরাধের আসামিদেরও পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার করে যথারীতি অসামরিক কারাগারে রাখা হয়েছে। সব আসামি জেল কোড-১৯২৬ অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষের হেফাজতে রয়েছেন এবং জেল কোড অনুসারেই সকল সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হচ্ছেন।

‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ তাদের প্রতিবেদনে হেফাজতে থাকাকালীন কয়েকজন আসামির মৃত্যু হওয়া সম্পর্কে অতিরঞ্জিত তথ্য প্রদান করেছে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তারা স্বাস্থ্যগত অসুস্থতা, বার্ধক্যজনিত ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছেন।

বিশেষ আদালতসমূহে দায়েরকৃত প্রতিটি মামলার বিচার কার্যক্রমের শুরু থেকেই সংবাদ মাধ্যমসমূহের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি, বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, প্রসিকিউটরের প্রেসব্রিফিং এবং আইনজীবীদের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রমের সংবাদ প্রতিবেদন গণমাধ্যমে সবসময়ই প্রচারিত হয়ে আসছে।

এ যাবৎ ঢাকার বাইরে স্থাপিত ৬টি আদালতে ৪৫টি মামলা এবং ঢাকার পিলখানায় ৫টি আদালতে ৭টি মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে পিলখানায় ৩টি আদালতে ৪টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ইতিমধ্যে বিদ্রোহ মামলার প্রায় ৭০ ভাগ বিচারকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। বিচারের রায়ে আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে এবং অনেকেই বেকসুর খালাস পেয়েছেন।

বিজিবি সদর দফতর বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানায়, সুপ্রিমকোর্টের আদেশ অনুযায়ী হত্যা, অগি্নসংযোগ, লুট এবং গুরুতর অন্যান্য অপরাধের বিচার মহানগর দায়রা জজ আদালতে দেশের প্রচলিত আইন ‘বাংলাদেশ দ-বিধি’ এবং ‘ফৌজদারি কার্যবিধি’ অনুযায়ী যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে।