এটিএম শামসুল হুদার সময়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) শত কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। বিভিন্ন কেনাকাটা ও নানা ধরনের তদবিরের মাধ্যমে এ দুর্নীতি হয়। ভোটার তালিকার প্রকল্পের জন্য ল্যাপটপ থেকে শুরু করে সর্বশেষ সার্ভার স্টেশনের ফ্ল্যাট কেনা পর্যন্ত প্রায় সবক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়। আর এর খেসারত বর্তমান কমিশনকে দিতে হচ্ছে বলে মনে করেন নতুন কমিশনাররা।
সাবেক সিইসিসহ ইসির বেশিরভাগ কর্মকর্তা এসব দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। কেনাকাটা, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান, পুরনো মালামাল কেনাবেচা, কমিশনের অধীনে থাকা বিভিন্ন বাড়ি-গোডাউনের ভাড়া, বিদেশ সফর, নির্বাচন বন্ধ করা, ফলাফল পাল্টানো, এমনকি রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রেও হয়েছে টাকার খেলা।
জানা গেছে, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এটিএম শামসুল হুদার সেচ্ছাচারিতার কারণেই এসব দুর্নীতির বিষয়ে তখন মুখ খুলতে সাহস পাননি ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা।
জুনিয়র কর্মকর্তাদের অনেকটা চাপ দিয়ে দুর্নীতি করতে বাধ্য করেছেন তিনি। এ কারণে নির্বাচন কমিশনে দিন দিন দুর্নীতির ডালপালা মেলেছে। বিগত কমিশনের প্রতিটি পদক্ষেপে দুর্নীতি হওয়ায় এখন ইসির অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যথাযথ গতিতে চলছে না দৈনন্দিন কাজগুলোও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ড. এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের শেষ সময়ে ব্যাগ কেনা কেলেঙ্কারি, সার্ভার স্টেশন স্থাপনের জন্য অতিরিক্ত ব্যয়ে ফ্ল্যাট কেনা, নিয়োগ ও বদলিবাণিজ্য, গেজেটবাণিজ্য, কমিশন সচিবালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কক্ষে চুরির নামে নিয়োগ পরীক্ষার টেব্যুলেশন শিটের নম্বর পরিবর্তন, গেজেট গায়েবসহ অসংখ্য দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বর্তমান কমিশন।
শামসুল হুদার কমিশন শেষ সময়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কাজের তথ্য সংগ্রহকারীদের সুবিধার দোহাই দিয়ে চার কোটি টাকার ব্যাগ কেনার উদ্যোগ নেয়। বর্তমান কমিশন ওই ঘটনা তদন্ত করে দুর্নীতির প্রমাণ পায়। জানা যায়, বিদায়ের ঠিক আগ মুহূর্তে চার কোটি টাকার ৭২ হাজার ব্যাগ কেনার বিষয়টি তড়িঘড়ি করে চূড়ান্ত করে কমিশন। এ কাজে দায়িত্ব দেওয়া হয় সিইসির নিকটাত্মীয় সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সমন্বয়ক আবদুল আলিম ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত প্রকল্প পরিচালক উপ-সচিব শাহজাহানকে।
হুদা কমিশন সার্ভার স্টেশন স্থাপনের জন্য অবিশ্বাস্য বেশি মূল্যে একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছে। সারাদেশে ৪৭০টি থানা ও উপজেলায় সার্ভার স্টেশন স্থাপনের কাজ শুরু করে কমিশন। এরই অংশ হিসেবে রাজধানীতে সাতটি সার্ভার স্টেশনের জন্য ফ্ল্যাট কেনা হয়। এগুলো হলো গুলশান, মিরপুর, পল্লবী, তেজগাঁও, ক্যান্টনমেন্ট, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর। এর মধ্যে মিরপুরের দুটি ফ্ল্যাটে প্রতি বর্গফুটের দাম পড়ছে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা করে যথাক্রমে মোট দুই কোটি ৩২ লাখ ছয় হাজার ৫০০ টাকা ও দুই কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতি বর্গফুট সাড়ে ১৮ হাজার টাকা করে বাড্ডার ফ্ল্যাটের দাম পড়ছে দুই কোটি ৪৬ লাখ পাঁচ হাজার টাকা। এটি কেনা হয়েছে আরমা রিয়েল এস্টেটের কাছ থেকে। আর প্রতি বর্গফুট ১৫ হাজার টাকা করে এস আসাদুজ্জামান নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে এক কোটি ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে তেজগাঁওয়ের সার্ভারের জন্য একটি ফ্ল্যাট। এভাবে রাজধানীর অন্য সার্ভার স্টেশনগুলোর জন্য ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রেও বাজার দরের চেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
হুদা কমিশনের আমলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনায় রীতিমতো দুর্নীতির মচ্ছব চলেছে। শুধু ইভিএম কেনায় দুর্নীতি হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার। এ ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় বিধিমালাসহ (পিপিআর) কোনো আইনই মানেনি হুদা কমিশন।
জানা যায়, বিগত কমিশন ২০১০ সালে কোনো ধরনের প্রজেক্ট প্রোফাইল বা নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করেই ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল সর্বপ্রথম ইভিএম কেনার চুক্তি হয়। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও ব্যুরো অব রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এক ইউনিটের ১৩০টি ইভিএম কেনার চুক্তি হয়। প্রতিটি মেশিনের দাম ছিল ১০ হাজার ৮০০ টাকা। এ হিসাবে ১৩০টি ইভিএমের দাম দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এরপর ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় দুই ইউনিটের ৪০০ ইভিএম কেনার জন্য ইসি ও বুয়েটের মধ্যে দ্বিতীয় চুক্তি সম্পাদিত হয়, যাতে প্রতিটির দাম ধরা হয় ৩২ হাজার টাকা। মোট এক কোটি ২৭ লাখ টাকা। তৃতীয় দফায় ২০১১ সালের ২৪ জুলাই তিন ইউনিটের ৭০০ ইভিএম কেনার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেডের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। এখানে প্রতিটি মেশিনের দাম ধরা হয় ৪৬ হাজার ৫০১ টাকা। মোট তিন কোটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার ৭০০ টাকা।
ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজে ব্যবহৃত সফটওয়্যার কিনতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ করেছে বিগত কমিশন। কিন্তু ওই সফটওয়্যারের কোনো স্বত্ব গ্রহণ করেনি ইসি। ফলে বর্তমান কমিশনকে প্রতিবার প্রতিটি সফটওয়্যার কিনতে হচ্ছে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা করে।
ভোটার পরিচয়পত্রের জন্য ল্যাপটপ কেনা নিয়ে দুর্নীতি ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মুখে। সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দিয়ে কয়েক কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ে কিছু ভোট কেন্দ্রে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) ব্যবহার করেছে ইসি। সাবেক সিইসির নিকটাত্দীয়ের মাধ্যমে এই সিসি টিভি সরবরাহ করা হয়। এ জন্য টেন্ডারও করা হয়নি। ওই সিসি টিভি পরবর্তীতে কোনো কাজেই আসনি।
পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় গেজেট প্রকাশ করা নিয়ে ইসিতে চলেছে জমজমাট গেজেটবাণিজ্য। বিষয়টি তদন্ত করে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পায় ড. হুদার কমিশন। তবে রহস্যজনক কারণে কারোই শাস্তি হয়নি। উল্টো বিদায়ের আগে তাদের পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করে হুদা কমিশন। নিয়োগ, বদলি ও
টাকার বিনিময়ে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের মিলেছে পছন্দের জায়গায় বদলির সুযোগ। আবার স্টেনোগ্রাফার বা নিম্ন কোনো পদ থেকে উপজেলা কর্মকর্তার চলতি দায়িত্বে আসীন হতে লেগেছে শুধু টাকা। টাকা দিলে সিনিয়রদের ডিঙিয়ে দেওয়া হয় পদোন্নতি। টাকা না ঢাললে বদলি করা হয়েছে প্রত্যন্ত এলাকায়। আটকে দেওয়া হয় পদোন্নতি। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি বাণিজ্য করে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন নির্বাচন কমিশনে প্রেষণে আসা উপসচিব শাহাজাহান মিয়া। সাবেক সিইসির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এ কর্মকর্তার প্রভাব-দুর্নীতির কারণে ক্ষুব্ধ, তটস্থ ছিল ইসির প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বলেন, ‘‘বিগত ইসি ইভিএম কেনার ক্ষেত্রে পিপিআর অনুসরণ করেনি। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আছে। অডিট বিভাগ রয়েছে। তারা এসব তদন্ত করতে পারে।’’
তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘‘আইন না দেখে কোনো কিছুই করা হয়নি। তবে সবকিছু ঠিক ছিল তাও নয়। চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে নির্বাচন হতো না।’’