এক সময়ে সারা বিশ্বের শিল্প, সাহিত্য, সভ্যতা, অর্থনীতি এবং শক্তির কেন্দ্রবিন্দু ছিল লন্ডন। লন্ডনের সেই জৌলুস এখন কিছুটা ম্রিয়মাণ। কালের পরিক্রমায় বিশ্বের সেরা নগরীর স্থানটি দখল করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক। কিন্তু আগামী কিছুদিন সারা বিশ্বের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু থাকবে এক সময়ের সেরা নগরী লন্ডনের দিকেই। সব আয়োজন শেষ করে এখন প্রস্তুত লন্ডন।

আজ রাতে পর্দা উঠছে ‘দ্য গেটেস্ট শো অন আর্থ’খ্যাত অলিম্পিকের। আধুনিক অলিম্পিকের এটা ২৭তম আসর। আর এ নিয়ে রেকর্ড তিনবার অলিম্পিকের আয়োজক হল ইংলিশদের গর্বের নগরী লন্ডন। পূর্ব লন্ডনের স্টার্টফোর্ডে ৫৩৭ মিলিয়ন পাউন্ড খরচে নির্মিত অলিম্পিক স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবে লন্ডন সময় রাত ৯টায়। উদ্বোধন করবেন ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

৩৬টি ডিসিপ্লিনে মোট ৩০২ ইভেন্টে ২০৪টি দেশের প্রায় ১০ হাজার অ্যাথলেট অংশ নিচ্ছেন এবারকার অলিম্পিকে। উদ্বোধনের আগেই ফুটবল ইভেন্ট শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। বুধবার মহিলা ফুটবলের পর গতকাল শুরু হয়েছে পুরুষ ফুটবল। তবে আজ উদ্বোধনের পর কাল থেকে শুরু হচ্ছে পদক লড়াই। এবার সবচেয়ে বড় দলটি স্বাগতিক গ্রেট ব্রিটেনের। দলটির অ্যাথলেট সংখ্যা ৫৪১।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে অংশ নিচ্ছে ৫৩০ জন। তৃতীয় স্থানে রাশিয়া। দেশটি থেকে অংশ নিচ্ছেন ৪৩৬ জন। আর বেইজিং অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় দল চীন থেকে এসেছেন ৩৮০ জন অ্যাথলেট। এবার বাংলাদেশ থেকে অংশ নিচ্ছেন পাঁচজন অ্যাথলেট। বেইজিং অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে পদক তালিকাল শীর্ষস্থান দখল করে বিশ্বকে চমক দেখিয়েছিল চীন। তার আগের তিন অলিম্পিকেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রাধান্য ছিল প্রায় একচেটিয়া। মনে করা হচ্ছে, লন্ডন অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শীর্ষস্থান হারাবে চীন। স্বাগতিক হওয়ার কারণে এবার পদক জয়ে দারুণ চমক দেখাতে পারে গ্রেট ব্রিটেন।

কাল থেকে পদক লড়াইয়ের আগে সারা বিশ্বের কৌতূহলী চোখ আজকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে। ২০০৮-এর বেইজিংয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মনে করা হয় অলিম্পিকের ইতিহাসের সেরা। আয়োজকরা সেবার আগের দিন পর্যন্তও কাকপক্ষীকেও জানতে দেয়নি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বিষয় নিয়ে। সময়মতো ঠিকই বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল চায়নিজরা। লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও গোপন রাখতে চেয়েছিলেন আয়োজকরা। কিন্তু মিডিয়া এবং মোবাইলের কল্যাণে আগেভাগেই জেনে গেছে সবাই। সেটা যাই হোক, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে জমকালো, চোখ ধাঁধানো-এমনটিই আশা আয়োজকদের। অনুষ্ঠানে পারফরমারের সংখ্যা ১০ হাজার।

ব্রিটেনের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিকে তুলে ধরা হবে রেওয়াজ অনুযায়ী। পুরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার। লন্ডন সময় রাত ৯টায় শুরু হয়ে তা শেষ হবে সাড়ে ১২টায়। অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ স্লামডগ মিলিয়নেয়ারের অস্কারজয়ী পরিচালক ড্যানি বয়েলের, ‘আইল অফ ওয়ান্ডার’। এটি একটি স্বপ্নের দ্বীপের নাম। বিশ্বখ্যাত এ ব্রিটিশ পরিচালক তার ‘আইল অফ ওয়ান্ডার’ তৈরি করতে প্রেরণা খুঁজেছেন উইলিয়ামস শেক্সপিয়ারে। আর ‘বি নট অ্যাফ্রেড, দ্য আইল ইজ ফুল অব নয়জেস’ শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটক টেমপেস্ট থেকে এ বিখ্যাত উক্তিটি নিয়ে বয়েল বেছে নিয়েছেন তার দ্বীপের নামটি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টেমপেস্টের থিমেই চলবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অনেক কিছু ফাঁস হয়ে গেলেও ড্যানির ‘আইল অফ ওয়ান্ডার’ নামক আশ্চর্য দ্বীপে কী আছে সেটা এখনও অনেকটা গোপন। তবে এটুকু জানা গেছে, অলিম্পিক স্টেডিয়ামে রাখা বিশাল এক ঘণ্টা বাজিয়ে শুরু হবে ড্যানির স্বপ্নের দ্বীপের কথকথা। এখানে ব্রিটেনের চিরসবুজ গ্রাম, উপত্যকা, পশুপাখি, ঐতিহ্যবাহী রেলমেশিন এমনটি বৃষ্টিস্নাত আবহাওয়াও তুলে ধরবেন ড্যানি। স্লামডগ মিলিয়নেয়ারের পর আবার একসঙ্গে কাজ করেছেন ভারতের বিশ্বখ্যাত সংগীত পরিচালক এআর রহমান। ড্যান বয়েলের জন্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি রক মিউজিকে সুর দিয়েছেন তিনি। একটি নাচের অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোরিওগ্রাফার আকরাম খান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আকর্ষণ বাড়িয়ে দেবে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের ‘জেমস বন্ড’। ‘দ্য অ্যারাইভাল’ নামে এ ছবিতে বন্ডের চরিত্রে আছেন ড্যানিয়েল ক্রেইগ। ছবিতে বাকিংহাম প্যালেসের ভেতর ক্রেইগের সঙ্গে দেখা যাবে স্বয়ং রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে।

উইলিয়াম ব্লেকের বিখ্যাত কবিতা ‘জেরুজালেম’-এ যেভাবে ফুটে উঠেছে অলিম্পিক পার্কও সেরকম ভিলেজের চেহারা নেবে। থাকবে ক্রিকেট ম্যাচ, ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়নের দৃশ্য। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে একঝাঁক সাবেক কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ প্যারেড করে অলিম্পিক পার্কে ঢুকবেন। তাদের নেতৃত্ব দেবেন কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকছেন ইংলিশ ফুটবল তারকা ডেভিড বেকহ্যামসহ অনেক নামিদামিরা। দর্শক মাতাতে মঞ্চে আসবেন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী স্যার পল ম্যাককার্টিনি। সঙ্গে একঝাঁক নন্দিত গায়ক-গায়িকা। সব দেশের ক্রীড়াবিদ করবেন মার্চপাস্ট। বক্তব্য রাখবেন ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির চেয়ারম্যান এবং আয়োজক কমিটির প্রধান। পতাকা উত্তোলন এবং তারপর অলিম্পিক মশাল প্রজ্বলন। পুরো অনুষ্ঠান সফলভাবে শেষ করতে এখন পুরোপুরি প্রস্তত লন্ডন।