অছাত্র ও আদু ভাইদের দিয়ে ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে যখন সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সভাপতি ও আমিরুল ইসলাম খান আলীমকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয় তখন বয়স্কদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের বঞ্চিত নেতারা ব্যাপক বিক্ষোভ করেছিলেন। গত সোমবার গঠিত নতুন কমিটিতে যাদের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের অনেকের বয়সই ৪০-এর ওপর। বিশেষ করে সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশীদ হাবিব, সিনিয়র সহসভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের বয়স ৪০-এর ওপরে। তাদের কারও ছাত্রত্ব নেই। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল কমিটি সাবেক ছাত্রলীগারদের দখলে চলে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মহিদুল হাসান হীরু এবং সাধারণ সম্পাদক মাসুদ খান পারভেজ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। মহিদুল হাসান হীরু ছাত্রলীগে থাকা অবস্থায় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের মিছিলে গুলি ছুড়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। সে সময় পত্রপত্রিকায় এ ছবি ছাপাও হয়েছিল। এছাড়া মাসুদ খান পারভেজ ছাত্রলীগ করতেন বলে ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতারা জানিয়েছেন।
ছাত্রদল বিএনপির সহযোগী সংগঠন। ১৯৭৯ সালে গঠিত এই ছাত্র সংগঠনের সর্বশেষ কমিটি গঠিত হয়েছিল ২০০৯ সালের ১ জুলাই। তাতে সভাপতি ও সম্পাদকের দায়িত্ব পান সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও আমিরুল ইসলাম খান আলীম। ৬ মাসের জন্য গঠিত ওই কমিটি ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে। মেয়াদোত্তীর্ণের আড়াই বছর পর নতুন এ কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে নতুন কমিটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর গতকাল সকাল থেকে ছাত্রদলের নতুন কমিটির নেতারা নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভিড় করেন। সেখানে বিভিন্ন ইউনিটের নেতারা তাদের স্বাগত জানান। তারা দুপুর পর্যন্ত ব্যাপক শোডাউন করেন। এরপর নেতারা রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চতুর্থ কারামুক্তি দিবস উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় যোগ দেন। অনুষ্ঠানে আগত নেতাকর্মীদের কাছে ছাত্রদলের সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে পরিচয় করিয়ে দেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের স্বাগতও জানান। সভায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা জুয়েল-হাবিবের নেতৃত্বাধীন কমিটির সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়ে স্লোগানও দেয়।
ঢাবিতে ছাত্রলীগের পাহারা, পুলিশ মোতায়েন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নতুন কমিটির সভাপতি মহিদুল হাসান হীরু এবং সাধারণ সম্পাদক মাসুদ পারভেজ গতকাল ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে যান। ছাত্রদলের নতুন কমিটির নেতারা ক্যাম্পাসে ঢুকেছেন-এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মধুর ক্যান্টিনসহ ক্যাম্পাসের সব গেটে পাহারা বসান। ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশঙ্কায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, ছাত্রদল ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে শেষ বারের মতো ক্যাম্পাসে ঢুকেছিল। এরপর তারা দুয়েক দিন রাজু ভাস্কর্য ও হাকিম চত্বর পর্যন্ত এলেও তাদের অবস্থানের স্থায়িত্বকাল ৫ থেকে ১০ মিনিটের বেশি হয়নি। গতকাল ছাত্রদল নেতাদের ক্যাম্পাসে আসার খবরে প্রবেশপথগুলো ও মধুর ক্যান্টিনে পাহারা বসায় ছাত্রলীগ। দিনভর তারা মহড়া দেয়। এ প্রেক্ষাপটে ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তাছাড়া পলাশীর মোড়, শাহবাগসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রবেশমুখে চলে তল্লাশি অভিযান।
এ ব্যাপারে রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আনোয়ার হোসেন জানান, ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর দলটির নেতা ও কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহড়া দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। সকালে রাজধানীর মিরপুর, কলাবাগান ও ইস্টার্ন প্লাজা এলাকার বেশ কয়েক ছাত্রনেতার লোকজন নিয়ে জড়ো হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এডিসি আনোয়ার আরও জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথগুলোর আশপাশে ছাত্রনেতারা জড়ো হয়ে একসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহড়া দিতে প্রবেশ করবে। এতে অন্য রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলো বাধা দিতে পারে। এমন আশঙ্কায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মনোমালিন্য ও বিরোধ রয়েছে। নতুন নেতৃত্ব চাচ্ছেন সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ সমস্যা দুয়েক দিনের মধ্যে সমাধান করে তারা এ সপ্তাহেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করবেন। এ সম্পর্কে জানতে ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির সভাপতি মহিদুল হাসান হিরু ও সাধারণ সম্পাদক মাসুদ পারভেজ খানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।
এ সম্পর্কে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ওমর শরীফ বলেছেন, অছাত্ররা যদি ক্যাম্পাসে ঢুকে বিশৃঙ্খলা করতে চায় তবে সাধারণ ছাত্ররা অবশ্যই বাধা দেবে।
পদবঞ্চিত নেতারা জানান, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার যে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই এখন আর ছাত্র নয়। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যে কমিটি অনুমোদন করা হয়েছে সে কমিটির নেতারা ছাত্র না হওয়ায় আবার ছাত্রদলের নতুন কমিটি ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবে না। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজে এই কমিটি অনুমোদন দেওয়ায় প্রকাশ্যে এ নিয়ে কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করেননি। কিংবা নতুন কমিটি প্রত্যাখ্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিবাদও করেননি।
ছাত্রদলের অনেক নেতা, সুশীল সমাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি সমর্থিত শিক্ষক সমিতির নেতারাসহ বিভিন্ন মহল থেকে ছাত্রত্ব রয়েছে এমন নেতৃত্ব চেয়েছিলেন। কিন্তু অছাত্র নেতাদের দিয়ে কমিটি গঠন করায় হতাশ তারা।
ছাত্রদলের নতুন কমিটি : আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে সভাপতি ও হাবিবুর রশীদ হাবিবকে সাধারণ সম্পাদক করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের পাঁচ সদস্যের কমিটি। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি হবে ২০১ সদস্যের। বাকিগুলো ১৫১ সদস্যের কমিটি। কমিটির বাকি সদস্যদের নাম শিগগিরই ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়েছে। গত সোমবার রাত সাড়ে ৩টায় পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কমিটিগুলো ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাকি ইউনিটিগুলোর অনুমোদন দেন নবনির্বাচিত সভাপতি এবং প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক নাসির। হাবিবুর রশীদ হাবিব যুক্তরাষ্ট্র থাকায় তার অনুপস্থিতিতে নাসির ইউনিটি কমিটির অনুমোদন বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
শেষ সময়ে বাদ পড়লেন যারা : সোমবার রাতে প্রথমে নুরুল ইসলাম নয়নকে সিনিয়র সহসভাপতি, ফিরোজকে প্রথম যুগ্ম সম্পাদক ও আহসান উদ্দিন শিপনকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদ দেওয়া হলেও শেষ রাতে বাদ পড়েন তারা। নয়নের জায়গায় আসেন বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, ফিরোজের জায়গায় আসেন ওবায়দুল হক নাসির এবং আহসান উদ্দিন খান শিপনের জায়গায় আসেন রাজিব আহসান।
কেন্দ্রীয় কমিটি : কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-সিনিয়র সহসভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ এবং রাজিব আহসান সাংগঠনিক সম্পাদক। কেন্দ্রীয় কমিটির নতুন সভাপতি জুয়েল আগের হেলাল-বাবু কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। আর হাবিব ছিলেন বিলুপ্ত কমিটির সহসভাপতি এবং ঢাকা দক্ষিণের আহ্বায়ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫১ সদস্যের কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ কমিটিতে সভাপতি মহিদুল হাসান হীরু, সাধারণ সম্পাদক মাসুদ খান পারভেজ, সিনিয়র সহসভাপতি সাদীউল কবির নিরব, যুগ্ম সম্পাদক নাসির উদ্দিন রুম্মন ও সাংগঠনিক সম্পাদক মিনহাজ উদ্দিন ভুঁইয়ার নাম অনুমোদন করা হয়েছে। অন্যদের নাম শিগগিরই জানানো হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নতুন কমিটিতে সভাপতি হিসেবে ফয়সাল আহমেদ সজল, সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক মুন্না, সিনিয়র সহসভাপতি রাজিব রহমান, যুগ্ম সম্পাদক খন্দকার আল আশরাফ মামুন এবং সাংগঠনিক সম্পাদক এবিএম মহসিন বিশ্বাসের নাম অনুমোদন করা হয়েছে। ১৫১ সদস্যের এ কমিটির বাকিদের নামও পরবর্তী সময়ে জানানোর কথা বলা হয়েছে।
১৫১ সদস্যের ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটিতে সভাপতি আবুল মুনসুর খান দীপক, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ন কবির রওশন, সিনিয়র সহসভাপতি শরিফ উদ্দিন জুয়েল, যুগ্ম সম্পাদক কামাল হোসেন এবং এসএম মিজানুর রহমানের নাম সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে অনুমোদন করা হয়েছে। অন্যদের নাম পরে জানানো হবে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে যথাক্রমে ইসহাক সরকার ও খন্দকার এনামুল হককে। এছাড়া মির্জা আসলাম আলীকে সিনিয়র সহসভাপতি, এ.এ. জাহির উদ্দিন তুহিনকে যুগ্ম সম্পাদক এবং কামরুজ্জামান টিপুকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। ১৫১ সদস্যের এ কমিটিরও পূর্ণাঙ্গ তালিকা পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
কমিটি ঘোষণার আগে গুলশান কার্যালয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত খালেদা জিয়া ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীকে নিয়ে বৈঠক করেন। ওই সময় গুলশান কার্যালয়ে সাবেক ছাত্রনেতাদের ভিড় দেখে ১২টার পর গুলশানের নিজ বাসভবনে এ্যানী, ছাত্রদলের সদ্যবিদায়ী সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু এবং নবনির্বাচিত আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল ও যুগ্ম সম্পাদক ওবায়দুল হক নাসিরকে নিয়ে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া।