অনিল কাপুর অভিনীত ‘নায়ক’ বা মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত ‘ফাটাকেষ্ট’ দেখেননি যোগাযোগ ও রেলপথমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অথচ তার নামের সঙ্গে এখন জুড়ে গেছে সিনেমা দুটির নাম। অনেকেই বলেন, সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য তিনি এসব (আকস্মিক সড়ক পরিদর্শন) করছেন। নির্দেশও দিচ্ছেন নায়কোচিত কায়দায়।  মন্ত্রীর ভাষায়-আসলে এটা সত্য নয়। অনিল কাপুরের সিনেমা কেবল ‘১৯৪২ এ লাভ স্টোরি’ই দেখেছেন তিনি।

সড়কের বেহাল দশায় ঝড়ো পরিদর্শন বা ফিল্মি ভিজিটে সত্যিই কোনো ফল হচ্ছে, নাকি তা নিতান্তই ক্যামেরা ট্রায়াল? এমন প্রশ্নে মন্ত্রীর সাফ জবাব, আমি গেলে তবুও কিছুটা কাজ হয়। কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন। না গেলে কিছুই হয় না।

বলিউডের সুপারহিট সিনেমা ‘নায়ক’। টিভি মিডিয়ার এক সামান্য রিপোর্টার অনিল কাপুরকে রাজ্য চালানোর ঝামেলা বোঝাতে ‘ভিলেন’ মুখ্যমন্ত্রী অমরেশ পুরী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন একদিনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার। অনিল কাপুর রাজি হন। রাজ্যের সব সমস্যা সমাধানে ‘নায়ক’ ছোটেন। আর তার পিছু পিছু টেলিভিশনের ক্যামেরা। প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিক আর জনগণ। মাত্র ২৪ ঘণ্টায় অখ্যাত এক রিপোর্টার টিভি ক্যামেরার কল্যাণে পরিণত হন জনপ্রিয় এক ‘নায়ক’-এ। এর ধারাবাহিকতায় তিনি ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও সফল হয়েছিলেন সিনেমার পর্দায়। শহরের কোনায় কোনায় রাখা অভিযোগ বাক্সে তখন একটিও অভিযোগ জমা পড়েনি। তার বদলে পড়েছে ফুল। এ হল সিনেমার ফ্যান্টাসি।

আর মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের স্টাইলটিও হয়ে দাঁড়াল চলচ্চিত্রের নায়কের ছায়ার মতো। ঢালিউডের রুপালি পর্দায় নয়, তিনি নায়কের মতো চিতা গতিতে ছুটছেন দেশের নানা প্রান্তে। গন্তব্য এবড়ো-খেবড়ো সড়ক। আর সড়ক যোগাযোগের অব্যবস্থাস্থল। পুলিশের কড়া পাহারায় আর আগাম নিরাপত্তা ফোর্সের পাশাপাশি আকস্মিক সফরে শুধু টিভি ক্যামেরার জোগান আসে না, আসেন খ্যাতিমান ও অতি সাধারণ স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিকরাও। মন্ত্রী এত সব মানুষের ভিড়েও টিকেট চোরাকারবারি, লাইসেন্সবিহীন চালক আর দালালদের হাতেনাতে ধরে ফেলেন! অনেক কর্মকর্তাকে করেন সাময়িক বরখাস্ত আবার কাউকে বদলি কিংবা শোকজ করার নির্দেশ।

গতকাল করিত্কর্মা ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গী হন সকালের খবরের এ রিপোর্টার। আকস্মিক পরিদর্শনের কথা বলা হলেও আগেই তা মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে  সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়ে দেওয়া হয়।

বেলা ১১টা। সচিবালয়ে নিজ দফতর থেকে মন্ত্রী নামছেন। ঝটিকা পরিদর্শনে যাবেন কমলাপুর রেলস্টেশন হয়ে যাত্রাবাড়ী মোড়। সেখান থেকে সুলতানা কামাল সেতু হয়ে কাঁচপুর ব্রিজের যানজট দেখতে। শেষ বর্ষার আকস্মিক বৃষ্টিও রুখতে পারেনি মন্ত্রীর যাত্রা। মন্ত্রীর গাড়ির পেছনে ছুটছে প্রটোকলসহ মিডিয়ার প্রায় দুই ডজন গাড়ি। সাড়ে ১১টায় মন্ত্রী কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছতেই রেলের ডিজিসহ পদস্থ কর্মকর্তারা তাকে ঘিরে ধরেন। স্টেশনের ভিআইপি গেটের বাম পাশে দুটি বস্তায় মোড়ানো ছিল বৈদ্যুতিক কেবল। মন্ত্রীর মোবাইল ফোনে কথা বলার ফাঁকে শ্রমিক দিয়ে তা সরানো হলেও দেখলেন না তিনি। যখন তিনি গেট দিয়ে ঢুকলেন তখন পুরো স্টেশনে প্রচার হয়েছে মন্ত্রী এসেছেন। সোমবার রাত ১০টা থেকে অপেক্ষারত ট্রেনের টিকেট প্রত্যাশীদের ধৈর্যের বাঁধ যেন ভেঙে গেল। রব উঠল ‘টিকেট চাই, টিকেট চাই। কালোবাজারি বন্ধ কর। বন্ধ কর।’

টিকেট প্রত্যাশীদের চিত্কার-চেঁচামেচি আর নিরাপত্তারক্ষীদের বাঁশির শব্দে এক তুলকালাম পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। মন্ত্রী সজোরে বলতে লাগলেন বাঁশি বন্ধ, বাঁশি বন্ধ। চেঁচামেচি থামাতে নিরাপত্তারক্ষীরা আরও জোরে বাঁশি ফুঁকতে লাগল। সারা স্টেশন জুড়ে তখন টিকেট চাই-টিকেট চাই চিত্কার। এরই মাঝে মন্ত্রীকে ঘিরে ধরেছেন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সদস্যরা।

মিডিয়াকর্মীদের ভেদ করে মন্ত্রীর কাছে ভিড়তে চাচ্ছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও রেলের কর্মকর্তারা। মন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বললেও আসলে তারা টিভি ক্যামেরায় চেহারা দেখাতেই বেশি আগ্রহী। তার প্রমাণও দিলেন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। প্রিন্ট মিডিয়ার কর্মীদের নাজেহাল করলেও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কর্মীদের প্রতি তারা ছিলেন সদয়। এই বিশাল বহর নিয়ে যখন মন্ত্রী টিকেট ক্রেতাদের লাইন ভেঙে টিকেট কাউন্টারের দিকে যাচ্ছেন। তখন পেছন থেকে লাইনে দাঁড়ানো অনেকে বলছেন, ‘টিকেট তো দিতে পারবে না, আসছে নাটক করতে। আমরা নাটক দেখতে চাই না। ঈদে বাড়ি ফেরার জন্য টিকেট চাই।’

মন্ত্রী প্রথমেই যান মহিলা কাউন্টারে। সেখানে অপেক্ষমাণদের সঙ্গে কথা বলে তিনি অন্য কাউন্টারে যান। ফলে মহিলা কাউন্টারের লাইন ভেঙে যায়। লাইনে দাঁড়ানো শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসুমা নাসরিন ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, টিকেট তো দিতে পারবেন না, আসছেন ঝামেলা পাকাতে। তার পাশে দাঁড়ানো গৃহিণী সামছুন্নাহার বেগম বলেন, এভাবে দেখে কোনো লাভ নেই। টিকেট তো কালোবাজারি হচ্ছে কাউন্টারের ভেতর থেকে। বাইরে পরিদর্শন করে লাভ কী? উল্টো মন্ত্রী আমাদের লাইনটা ভেঙে দিলেন। অপর লাইনে দাঁড়ানো শিক্ষার্থী ফাহিম মন্ত্রীকে উদ্দেশ করে চিত্কার করে বলেন, আমি গত রাত ১০টা থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছি আমাকে টিকেট দেন। মন্ত্রী তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সান্ত্বনা দেন এবং সঙ্গে থাকা রেলের ডিজি আবু তাহেরকে টিকেট দিতে বলেন। ডিজি মন্ত্রীর সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মন্ত্রী দর্শনের পর ফাহিম নিজের লাইনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। স্টেশনের পশ্চিম পাশের চট্টগ্রামগামী ট্রেনের কাউন্টারে যান মন্ত্রী। লাইনে দাঁড়ানো অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একজন টিকেট কালোবাজারিকে ধরে মন্ত্রীর সামনে আনেন। ওই দালালের নাম আবিদ। গত রোববার সে টিকেট কালোবাজারির অভিযোগে আটক হয়। পরে তাকে ছেড়েও দেওয়া হয়। মন্ত্রী ওই কালোবাজারির বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। এ সময় টিকেট প্রত্যাশীরা মন্ত্রীর কাছে টিকেট চান। রবিউল ইসলাম নামে এক গার্মেন্টস শ্রমিক মন্ত্রীকে পেয়ে লাইন ছেড়ে সামনে এসে অভিযোগ করেন, ‘মোবাইল ফোনে টিকেট পাচ্ছি না।’ তিনি মন্ত্রীর কাছে অনেকটা মারমুখী ভঙ্গিতে টিকেট চান। মন্ত্রী রবিউলের হাত ধরে রেলের এক কর্মকর্তার কাছে দিয়ে বলেন, ওকে টিকেট দিন। ও মোবাইলে টিকেট পাচ্ছে না। একটু পর মন্ত্রী গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলে রেলের ওই কর্মকর্তা রবিউলকে ধাক্কা দিয়ে লাইনে দাঁড়াতে বলেন। এবার রবিউলের জায়গা হয় লাইনের অনেক পেছনে। ক্ষুব্ধ রবিউল বলেন, মন্ত্রী ভালো মানুষ কিন্তু ওই বেটা খুব খারাপ। এরপর মন্ত্রী জনসাধারণের দাবি শুনে বলেন, আমাদের সম্পদ সীমিত। ইঞ্জিন, কোচ ও আসন যা আছে এর বাইরে বেশি ট্রেন ও আসন দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে যারা সারারাত কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন তাদের দাঁড়ানো টিকেট হলেও যেন দেওয়া হয়। কেউ গাড়ির ছাদে উঠবেন না। মন্ত্রীর এ ঘোষণার পর রেলের ডিজি আবু তাহের সংশ্লিষ্টদের এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার নির্দেশ দেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিট ছাড়া টিকেট কেউ নিতে আগ্রহী ছিল না।

দুপুর ১২টার দিকে স্টেশন থেকে সায়েদাবাদের উদ্দেশে রওনা হন। ধলপুর কমিউনিটি সেন্টারের সামনে দিয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কাছে যানজটের কবলে পড়েন মন্ত্রী। ফ্লাইওভারের নিচে বিভিন্ন সেবাখাতের কেবল অপসারণের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। খোঁড়াখুঁড়ি ও বৃষ্টির পানিতে রাস্তায় হাঁটার মতো অবস্থাও ছিল না। মন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে কর্তব্যরত পুলিশের কাছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণ জানতে চান। এ সময় মন্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক জিল্লার রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। তিনি ঈদের আগে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করারও নির্দেশ দেন। এ সময় রাস্তা সংস্কার করতে এলাকাবাসী মন্ত্রীর কাছে দাবি জানাতে থাকেন। মন্ত্রীর গাড়ির বহরের কারণে যানজট আরও তীব্র আকার ধারণ করে। ওবায়দুল কাদের পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এই ফ্লাইওভার আমার মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট নয়। এটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু গাড়ি ও যানজট যেহেতু আমার মন্ত্রণালয়ের তাই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়টিও আমাকে দেখতে হবে।

পরের যাত্রা সুলতানা কামাল সেতুর দিকে। সেতু পার হয়ে পূর্বপাশে মোড়ে মন্ত্রীর গাড়ি দাঁড়ায়। এখানে মন্ত্রী স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলেন। প্রায় ১০ মিনিট অবস্থান করায় প্রত্যেক পাশে তীব্র যানজট দেখা দেয়। এরপর গাড়ির বহর নারায়ণগঞ্জের দিকে ছোটে। কাঁচপুর ব্রিজ দিয়ে পুনরায় গাড়ির বহর রাজধানীতে প্রবেশ করে। ফেরার পথে মাতুয়াইলে রাস্তার মাঝে দি লক্ষ্মী ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড সার্ভিসের একটি গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে থাকতে দেখে মন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে দায়িত্বরত সার্জেন্টের কাছে এর কারণ জানতে চান। দ্রুত গাড়ি অপসারণের নির্দেশ দিয়ে মন্ত্রী নিজের গাড়িতে উঠে বসেন।

উল্লেখ্য, যোগাযোগমন্ত্রী গত রোববারেও দাবি করেছেন দেশের ৯০ ভাগ সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা ভালো। ১০ ভাগের অবস্থা খারাপ। তবে গত ৩ আগস্ট চাঁদপুরের রাস্তা পরিদর্শনকালে মন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এত খারাপ রাস্তা আমি জীবনে দেখিনি। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আমি লজ্জা পাচ্ছি। আমি জনগণের কাতারে থাকলে ধর্মঘট করার করতাম।  এর আগে চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শনকালে মন্ত্রী বলেন, চাঁদপুরে রেলে লুটপাটের রাজত্ব চলছে। নামমাত্র মূল্যে রেলওয়ের অনেক জমি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ের কিছুু কর্মকর্তা এখানে হরিলুট করছে। এর আগে গত ২৬ জুলাই পটুয়াখালী, বাউফল ও বরগুনার কয়েকটি সড়ক প্রদর্শনকালে যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, আমি সড়কের ডাক্তার, সড়ককে চলাচল উপযোগী করে রাখাই আমার কাজ। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা অভিযানে নানা অভিযোগে অনেক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তও করেন।