দৈনন্দিন জীবনে যে কয়েকটি অসুখ হঠাত্ই সুখ কেড়ে নিতে পারে তাদের মধ্যে মাথাব্যথা অন্যতম। মাথাব্যথা খুব সহজেই কর্মচাঞ্চল্য কিংবা উচ্ছলতাকে বিনষ্ট করে মুহূর্তের মধ্যে আপনাকে স্থবির করে ফেলতে পারে। হঠাত্ই ঘায়েল করা এই মাথাব্যথার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হল মাইগ্রেন। মাইগ্রেনের আক্রমণে অনেকেই অসহায়। বারবার আঘাত হানা এই মাইগ্রেন নিয়ে অনেকের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্ত ধারণা ও দুশ্চিন্তা। আর দুশ্চিন্তার কারণও আছে, কারণ মাথাব্যথার পেছনে ব্রেন টিউমার থেকে শুরু করে চোখের নানা সমস্যা, সাইনাসের ইনফেকশন, উচ্চ রক্তচাপ, এমনকি সাধারণ টেনশনও দায়ী হতে পারে। সমস্যাটিকে যদি মাইগ্রেন বলে শনাক্ত করা যায় তখন এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে মাইগ্রেন চিরতরে নির্মূল করা যায় না, চিকিত্সায় এর প্রকোপ কমিয়ে আনা যায়, বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়-এটাই আশার কথা।

মাইগ্রেন কী?
মাইগ্রেন এক বিশেষ ধরনের আধ কপালে মাথাব্যথা, যেটি প্রায়ই এবং বারবার আঘাত হানে। এটি সাধারণত মাথার যে কোনো এক পাশের একটি স্থান থেকে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে সেই পাশের পুরো স্থানেই বিস্তৃত হয়। মাথাব্যথার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর দৃষ্টিবিভ্রম এবং বমি কিংবা বমি বমি ভাব থাকতে পারে।
কেন হয়?
মাইগ্রেন কেন হয় তা পুরোপুরি জানা যায়নি। বলা হয়ে থাকে, রক্তে সেরোটোনিন অথবা ফাইভ এইচটির মাত্রা পরিবর্তিত হলে মস্তিষ্কে স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়। মস্তিষ্কের বহিরাবরণে যে ধমনিগুলো আছে সেগুলো মাথাব্যথার প্রারম্ভে স্ফীত হয় এবং ফুলে যায়।
তবে-
এটি বংশগত হতে পারে।
এটি পুরুষ অপেক্ষা মহিলাদের বেশি হয়।
দুশ্চিন্তা, মাসিকের সময় এটি বেশি হয়।
দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উজ্জ্বল আলো, কোষ্ঠকাঠিন্য এই রোগকে ত্বরান্বিত করে। পনির, চকলেট, শেরি, রেড ওয়াইন মাইগ্রেন আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। দেখা গেছে, এই খাদ্যবস্তুগুলোর মধ্যে উপস্থিত ‘টাইরামিন’ এ জন্য দায়ী। 
পরীক্ষা নিরীক্ষা
মূলত রোগের ইতিহাস থেকেই চিকিত্সকরা মাইগ্রেন শনাক্ত করেন। এ ছাড়া চোখ পরীক্ষা করতে হবে। সাইনাসের জন্য প্রয়োজনীয় এক্স-রে করতে হবে। বারবার এক জায়গায় ব্যথা হলে মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান করতে হবে।
চিকিত্সা
আজকাল মাইগ্রেনের নানারকম চিকিত্সা আছে। চিকিত্সার লক্ষ্য দুটি। প্রথমত তাত্ক্ষণিকভাবে মাথাব্যথা কমানো এবং দ্বিতীয়ত মাথাব্যথার প্রকোপ কমিয়ে আনা বা নিয়ন্ত্রণে রাখা। উভয় লক্ষ্য অর্জনে ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ আছে। চিকিত্সকের পরামর্শক্রমে সঠিক নির্দেশনা সাপেক্ষে সেসব ওষুধের ব্যবহারবিধি জেনে তারপর প্রয়োজনমতো সেগুলো খাওয়া উচিত। 
রোগের তীব্র সংক্রমণের সময় : অ্যাসপিরিন, প্যারাসিটামল, প্রোক্লোরপেরাজিন, যেমন-স্টেমিটিল; ঘুমের ওষুধ হিসেবে পরিচিত ডায়াজিপাম, যেমন-সেডিল; ক্ল্যাসিক্যাল মাইগ্রেনে আগে আর গোটামিন টারটেট, যেমন-কেফারগোট ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এর অতিরিক্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য বেশিরভাগ চিকিত্সক এটি ব্যবহার করছেন না। সাম্প্রতিককালে টলফেনামিক অ্যাসিড, রিজাট্রিপটান, জলমিট্রিপটান বেশ ব্যবহূত হচ্ছে।
প্রকোপ কমানোর জন্য :  ফ্লনারিজিন,  পিজোটিফেন,  টোপিরামেড, এমিট্রিপটাইলিন, প্রোপানললসহ বিভিন্ন ওষুধ সম্প্রতি মাইগ্রেনে ব্যবহূত হচ্ছে। এর ফলাফলও ভালো।
শেষ কথা
গ্রাম দেশে অনেক মাথাব্যথার রোগীকে একটি সুতা পেঁচিয়ে তার সঙ্গে মাছি বেঁধে রাখতে দেখা যায়। জিজ্ঞেস করলে জানা যায় তাদের বাণ মারা হয়েছে। এর প্রতিষেধক হিসেবে তারা ওই জাতীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এরা মাইগ্রেনের রোগী। সুতরাং মাথাব্যথায় বিপর্যস্ত না হয়ে সঠিক সময় চিকিত্সকের শরণাপন্ন হতে হবে। আরেকটি কথা, কেবল ওষুধ চিকিত্সাই নয়, কিছু খাবার এড়িয়ে চলাসহ মাইগ্রেনের রোগীর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবার সহানুভূতি।
উপসর্গ
মাইগ্রেন বয়ঃসন্ধিকালে শুরু হয় এবং মাঝ বয়স পর্যন্ত বারবার আঘাত হানে।
রোগী কিছুদিন বা কয়েক মাস পর পর আক্রান্ত হয়।
মাথাব্যথা শুরু হলে তা কয়েক ঘণ্টা, এমনকি দু’তিন দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটি রোগীকে দুর্বল এবং বিপর্যস্ত করে ফেলে।
মাইগ্রেনের কয়েকটি ধরন আছে। তার একটি ক্লাসিক্যাল বা সচরাচর মাইগ্রেন।
ক্লাসিক্যাল মাইগ্রেনের শুরুটা অধিকাংশ সময়েই রোগী বুঝতে পারেন। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর দৃষ্টিবিভ্রম হয়। রোগী চোখের সামনে আলোর ঝলকানি, চোখে শর্ষে ফুল দেখেন।
এরপর শুরু হয় মাথাব্যথা, যা মাথার এক পাশের একটি স্থান থেকে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে সেই পাশের পুরো স্থানেই বিস্তৃত হয়। প্রচণ্ড দপদপে ব্যথা রোগীকে কাহিল করে ফেলে। রোগীর প্রচুর ঘাম হয়। বমি কিংবা বমি বমি ভাব হয়। রোগী আলো এবং শব্দ একদম সহ্য করতে পারে না। কথা বলতেও অনিচ্ছা প্রকাশ করে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। চুপচাপ অন্ধকার ঘরে থাকতেই রোগী তখন পছন্দ করে।
ক্লাসিক্যাল মাইগ্রেন ছাড়া মাইগ্রেনকে কমন, ব্যাসিলার আর্টারি, হেমিপ্লেজিক, অপথালমোপ্লেজিক মাইগ্রেন ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
কমন মাইগ্রেইন সাধারণত দৃষ্টি-বিভ্রম থাকে না।
ব্যাসিলার আর্টারি মাইগ্রেনে ব্যথা সাধারণত পেছন থেকে শুরু হয়। এর সঙ্গে মাথা ঘোরা ভাব থাকে, দৃষ্টিবিভ্রম থাকতে পারে। আবার নাও থাকতে পারে।
হেমিপ্লেজিক মাইগ্রেনের ব্যথা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। শরীরে অবশ ভাব থাকে। এটি সারতে বেশ কিছুদিন সময় নেয়।