গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি আবির্ভাবের পর থেকেই বিশ্বব্যাপী মোবাইল ফোনের ব্যবহার নাটকীয়ভাবেই বৃদ্ধি পেয়ে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়নের দেওয়া হিসাব মতে, বিশ্বে বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫০০ কোটি। মোবাইল ফোনের ব্যবহার মানবদেহে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে – এমন একটি ধারণা গত দশক কিংবা তারও আগে থেকেই আলোচিত হয়ে আসছিল। বিশেষ করে মোবাইল ফোন ব্যবহারকালে বিচ্ছুরিত দ্রুত তরঙ্গায়িত বৈদ্যুতিক চুম্বক মানুষের মস্তিষ্কে ক্যান্সারের জন্ম দিতে পারে বলে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কিন্তু তাতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের তীব্রতার ওপর কোন বিরূপ প্রভাব ফেলেনি।

সম্প্রতি সেই আশংকাটি নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীনস্থ ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) গত ৩১ মে মোবাইল ফোন থেকে বিচ্ছুরিত দ্রুত তরঙ্গায়িত বৈদ্যুতিক চুম্বককে মানবদেহে ক্যান্সার উৎপাদনকারী সম্ভাব্য উপাদান হিসেবে শনাক্ত করার পর। সংস্থাটি মত দেয় যে, তারবিহীন ফোনের ব্যবহার মানবদেহে ক্ষতিকর এক প্রকার টিউমার তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় যা থেকে মানুষের মস্তিষ্কে ক্যান্সার জন্ম নিতে পারে। দ্রুত তরঙ্গায়িত বৈদ্যুতিক চুম্বক থেকে যে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এ সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয় ২৪ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ফ্রান্সের লিয়নে অনুষ্ঠিত আইএআরসি’র একটি ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায়। এ সভাটির আয়োজনই করা হয়েছিল দ্রুত তরঙ্গায়িত বৈদ্যুতিক চুম্বক মানবদেহের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা যাচাই করার জন্য। বিশ্বের ১৪টি দেশের মোট ৩০ জন বিজ্ঞানী এ বৈঠকে যোগ দেন। তাদের মতামত আইএআরসি’র ১০২ নম্বর প্রতিবেদনে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

মোবাইল ফোন যে ধরনের রশ্মি বিকিরণ করে তা স্থূলানু নির্মাণের ক্ষমতা রাখে না। এটি রঞ্জন রশ্মি কিংবা গামা রশ্মির মতো দেহ কোষের অণু থেকে বৈদ্যুতিক পরমাণুকে টেনে বের করে আলাদা করতে পারে না। ফলে এটি শরীরের ডিএনএ এবং অন্যান্য জৈবিক সূক্ষ্মাণুকেও নষ্ট করতে পারে না। একটি রাসায়নিক যৌগকে ভেঙে নতুন একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া তৈরির জন্য যেটুকু শক্তি লাগে মোবাইল ফোন নিঃসৃত রশ্মির শক্তি তার চেয়ে লাখ লাখ ভাগ ছোট। তবে দ্রুত তরঙ্গায়িত বৈদ্যুতিক চুম্বক যে পদার্থের সংস্পর্শে আসে সে পদার্থেই সে কিছুটা তাপ উৎপাদন করে থাকে। আর এ তাপ উৎপাদনের মাধ্যমেই সে বেশ বড়মাত্রায় জীবকোষের ক্ষতি সাধন করতে পারে। নববইয়ের দশকের শেষের দিক থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মোবাইল ফোন থেকে বিচ্ছুরিত মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রশ্মির পরিমাণ কীভাবে কমিয়ে আনা যায় তা নিয়ে নানা ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকায় এই প্রথম আইএআরসি মোবাইল ফোন থেকে বিচ্ছুরিত দ্রুত তরঙ্গায়িত বৈদ্যুতিক চুম্বক মানবদেহের ওপর কতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা যাচাই করে দেখার ব্যাপারে তৎপর হয়। বিশেষত বিচ্ছুরিত রশ্মি থেকে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা কতটা তা যাচাই করতে শুরু করে।

এর আগ পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ব্যাপারে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন প্রোটেকশনের (আইসিএনআইআরসি) গবেষণার ওপরই নির্ভর করে এসেছে। আইসিএনআইআরসি বলে এসেছে, মোবাইল ফোন থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মি থেকে ক্যান্সার হওয়ার কোনো কারণই নেই। অর্থাৎ মোবাইল ফোন ব্যবহার আর ক্যান্সার হওয়ার মধ্যে কোনো যোগসূত্রই থাকার কথা নয়। আইএআরসি’র ওয়ার্কিং গ্রুপে অংশগ্রহণকারী ৩০টি দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে ২৭টি দেশের বিজ্ঞানীরাই বলেছেন, মোবাইল ফোন ব্যবহারে মস্তিষ্কে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা তাদের এই অবস্থান এখনই প্রকাশ না করার আহবান জানিয়েছেন। ওয়ার্কিং গ্রুপের এ বিজ্ঞানীরা ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব এবং ক্যান্সার সম্পর্কিত গবেষণা লব্ধ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ ধারণায় উপনীত হয়েছেন। সেই সঙ্গে তারা ক্যান্সার তৈরির জন্য দায়ী উপাদানের জৈবিক গঠন প্রণালীও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তারা ক্যান্সার সংগঠনে সহায়ক সম্ভাব্য ২৬৬টি উপাদানকে শনাক্ত করেছেন। এসবের মধ্যে কফি পান, ড্রাই ক্লিনিং ও অগ্নিনির্বাপণ পেশায় যুক্ত থাকা, সাগরে নিঃসৃত জ্বালানি তেল, এবং এমনকি প্রক্রিয়াজাত শাকসবজিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে এসব উপাদান বাস্তবিকই মানবদেহ কিংবা প্রাণীদেহে কতটা ক্ষতি করে সে সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত যথেষ্ট পরিমাণে সংগৃহীত হয়নি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাধারণ মানুষ যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন কিংবা মোবাইল ফোন ব্যবহার প্রশ্নে যারা নীতিনির্ধারক তারা তাদের দেশের মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীকে মোবাইল ফোন ব্যবহারে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য কী ধরনের কৌশল আবিষ্কার করেছেন? নাকি ব্যাপারটি এমন যে, কফি খাওয়ার কারণে ক্যান্সারের যেরকম ঝুঁকি রয়েছে মোবাইল ফোন ব্যবহারেও ঝুঁকি ঠিক সেরকমই? আইএআরসি প্রণীত প্রতিবেদন থেকে এ প্রশ্নের তেমন একটা উত্তর পাওয়া যায় না। তাছাড়া এ প্রতিবেদনে মানবদেহে ক্যান্সার সংঘটনের পরিমাণগত মাত্রা নিয়েও কিছু বলা হয়নি। তবে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের ওপর ২০০৪ সাল পর্যন্ত চালানো জরিপে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্বের ১৩টি দেশের ২১ জন বিজ্ঞানী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্বলিত প্রতিবেদনটি ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছে, যারা অতিমাত্রায় মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী অর্থাৎ যারা দৈনিক ৩০ মিনিট করে টানা ১০ বছর মোবাইল ফোনে কথা বলেছে বা বলবেন তাদের দেহে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। তাছাড়া পরিবেশগত এমন কিছু উপাদানও হয়তো আছে যা মানবদেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বিষয়টির ওপর বিশ্বের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জনস্বাস্থ্য বিভাগকেই নজর দিতে হবে।

আইএআরসি’র পরিচালক ক্রিস্টোফার ওয়াইল্ড বলেন, দীর্ঘসময় এবং দীর্ঘদিন ধরে মোবাইল ফোনের ব্যবহার মানবদেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি কতটা বাড়ায় তা নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে সে কাজগুলো হওয়ার আগে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে আনার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীরা সতর্কতামূলক কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। যেমন মোবাইল ফোনে যত কমবার এবং যত কমসময় ধরে কথা বলা যায় সে ব্যাপারে সচেতন থাকা। যেসব স্থান বা পরিবেশে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক খুব সহজে পাওয়া যায় কথা বলার সময় সেসব স্থান বেছে নেওয়া, তাতে করে ফোন থেকে রশ্মি বিকিরণের মাত্রা অনেক কমে আসবে। তাছাড়া মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় ফোন সেটটি যতটা সম্ভব শরীর থেকে বা কান থেকে একটু দূরে রাখা।

এদিকে মোবাইল ফোন প্রস্ত্ততকারী কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইএআরসি’র প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি যে, মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে ক্যান্সার হবেই। এক্ষেত্রে তারা কেবল একটি আশঙ্কার কথাই ব্যক্ত করেছে। তাছাড়া স্বাভাবিক ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি আছে এমন কথাও বলা হয়নি। কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, মোবাইল ফোন তৈরি করার সময়ই এটি থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মির হাত থেকে মানবদেহকে কীভাবে রক্ষা করা হবে সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তবে এ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা যথেষ্ট কিনা সেটি আইএআরসি’র গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছে