গতকাল মঙ্গলবার সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া দেশরক্ষায় যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন।তিনি বলেন, আগেও স্বৈরাচারের পতন না ঘটিয়ে ঘরে ফিরিনি। আজ বলছি, অত্যাচারী সরকারের পতন না ঘটিয়ে ঘরে ফিরব না।

খালেদা জিয়া বলেন, সিলেটের শাহজালাল ও শাহপরানের মাজার জিয়ারত করে আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দিচ্ছি। জনতার ঢল নেমেছে। এ ঢল দমাতে পারবেন না। শিগগির পদত্যাগ করুন। দেরি করবেন না। তাহলে জনগণের ধাক্কায় পড়ে যাবেন। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। এ দেশকে গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্ত করতে আরেকটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিন। এ যুদ্ধ দেশরক্ষার যুদ্ধ, আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। আপনারা সবাই জেগে উঠুন। তিনি বলেন, আমরা সিলেট থেকেই সব আন্দোলন ও প্রচারণা শুরু করি। এবারও সিলেট থেকেই রোডমার্চ শুরু হল। সারাদেশে এ রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হলে আরও কড়া কর্মসূচি দেব।
লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে অনুষ্ঠিত হল বিএনপির প্রথম বিভাগীয় রোডমার্চ। কর্মসূচিতে বিএনপির পাশাপাশি অংশ নেন জোট ও সমমনা দলের শীর্ষ নেতারা।
খালেদা জিয়া তার বক্তৃতায় বলেন, আওয়ামী লীগ কি ঘরে ঘরে চাকরি দিয়েছে। এ সরকার থাকলে ভবিষ্যতে দেশের যুবসমাজ কেরানির চাকরিও পাবে না। খালেদা জিয়া বলেন, আমরা জোর করে ক্ষমতায় যাওয়া বিশ্বাস করি না। তাই জনগণের দাবি মেনে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করছি। সে নির্বাচনে জনগণ যাদের ভোট দেবে তারাই ক্ষমতায় যাবে।
খালেদা জিয়া আরও বলেন, সরকার দলীয় লোকদের ব্যাংক দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক নতুন করে ব্যাংকের লাইসেন্স না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তারপরও ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। সরকারি দলের লোকদের ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার মাধ্যমে টাকা বিদেশে পাচার করে দেয়া হবে। এসব সরকারের চক্রান্ত। কিন্তু আমরা সরকারের এসব চক্রান্ত সফল হতে দেব না। জনগণকে এই চক্রান্তের প্রতিবাদ করতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার একটি অবৈধ সরকার। তারা বিদেশিদের হাত ধরে বিদেশিদের টাকায় ক্ষমতায় এসেছে তাদের স্বার্থরক্ষায়। খালেদা জিয়া বলেন, আগে বলা হয়েছিল ট্রানজিট দিলে দেশ সিঙ্গাপুরে পরিণত হবে। আসলে এ চুক্তির মাধ্যমে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হবে। যে ঋণ নিয়ে ভারতের জন্য রাস্তাঘাট তৈরি করা হচ্ছে তার সুদ আমাদের ঘাড়ে। একসময় দেশ দেউলিয়া হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, সরকার প্রতিদিন ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। এভাবে চললে দেশ দেউলিয়া হতে বাধ্য। ভারতের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে আসামকে ১২০০ একর জমি প্রদানের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, আসামের মুখ্যমন্ত্রী আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তার সে চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ৩৫৭ একর। আর আসাম নিয়ে গেছে ১২০০ একর। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করে বলেন, এ জমি কি আপনার পৈতৃক সম্পত্তি? তিনি বলেন, সীমান্তে প্রতিদিন মানুষ হত্যা হচ্ছে অথচ আমাদের সরকার তার প্রতিবাদ করতে পারছে না। আমরা সরকারকে সাহস দিতে চেয়েছি, কিন্তু তারা সেটা নিতে রাজি নয়। যদি আবার চাকরি না থাকে।
খালেদা জিয়া বলেন, উনি (প্রধানমন্ত্রী) সেদিন গেলেন পূজা দেখতে। গিয়ে বললেন, আমাদের মা দুর্গা এসেছেন গজে চড়ে। উনার মা দূর্গা এসেছেন। বলেননি যে, আপনাদের মা দূর্গা। উনি যে কিসে বিশ্বাস করেন, কোন ধর্মে বিশ্বাস করেন তা বলা মুশকিল। উনি কি মুসলমান। এর আগে যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন আল্লাহর ওপর বিশ্বাস আস্থা রেখেছিলেন। খালেদা জিয়া বলেন, জিয়াউর রহমান সংবিধানে কয়েকটি ধারা সংযোজন করেছিলেন। তার মধ্যে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা ও গণভোট। এ সরকার তার সবগুলোই বাতিল করেছে। হিন্দু সম্প্রদায়কে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন ছাড়ার আহ্বান জানিয়ে খালেদা বলেন, আওয়ামী লীগ হিন্দুদের ওপর অত্যাচার ও তাদের সম্পদ লুট, ভূমি দখল করে। তারা মনে করে, হিন্দুরা যাবে কোথায়। আমি তাদের বলতে চাই, আওয়ামী লীগ ছাড়ুন, আপনারা ভালো থাকবেন।

বিরোধী দল নির্যাতনে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করার অভিযোগ তুলে পুলিশ প্রশাসনকে সতর্ক করে দেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, হরতালে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্মমভাবে নির্যাতন করছেন। হরতালে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তিনি এখনও পঙ্গু প্রায়। সেদিন হরতালে একজন চাকরিজীবী পথচারীকে পুলিশ বুটের চাপা দিয়েছে। তিনি পুলিশকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনাদের এ অধিকার কে দিয়েছে। এ বুট জনগণের করের টাকায় কেনা, পুলিশের বেতন দেওয়া হয় জনগণের করের টাকায়। এসব মানা যায় না, তাই আন্দোলন করতে বাধ্য হয়েছি। ভবিষ্যতে আরও আন্দোলন আসছে সেখানে জনগণের সঙ্গে ভাই-বোনের মতোই আচরণ করুন। অন্যথায় ভবিষ্যতে চাকরি রক্ষা করা যাবে না। যারা এ জন্য দায়ী তাদের বিচার করা হবে। নির্দেশ দেওয়া মন্ত্রীও রক্ষা পাবে না।
খালেদা জিয়া বলেন, সরকার বলছে দেশ ভালোই চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশ ভালো চললে ৩ বছরের শাসনামলে একটি নতুন শিল্পও কেন প্রতিষ্ঠা হল না। উল্টো একের পর এক শিল্প-কারখানা বন্ধ হচ্ছে বিদ্যুৎ-গ্যাসের অভাবে। দেশে কর্মসংস্থানের বদলে বেকারত্ব বাড়ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, জামায়াত নেতা নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীকে মানবতা বিরোধিতার দায়ে আটক করা হয়েছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য এবং ‘৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য জামায়াতকে হাত ধরে টেনে এনেছে। তখন কি তারা মানবতাবিরোধী অপরাধী ছিল না। তিনি বলেন, আপনাদের পক্ষে বললে স্বাধীনতাবিরোধী নয়, আর মানুষের পক্ষে বললে স্বাধীনতাবিরোধী হয়ে যায়। অথচ বিদেশি সংস্থাগুলো বলছে বিচার আন্তর্জাতিক মানের নয়। তিনি বিএনপি নেতা সালাউদ্দিনসহ জামায়াত নেতাদের মুক্তি দাবি করেন।

মহাসমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল অলি আহমদ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এমকে আনোয়ার এমপি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আসম হান্নান শাহ্, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, সাদেক হোসেন খোকা, ড. মঈন খান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, তরিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ শাহজাহান, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. ইব্রাহীম, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মজিবুর রহমান, শমসের মবিন চৌধুরী, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধানসহ জোটের সমমনা দলের নেতারা।
নগরীর রিকাবিবাজার ভিআইপি সড়ক, চৌহাট্টা-জিন্দাবাজার রোড, দরগা গেট সড়ক, আম্বরখানাসহ দরগার আশপাশের সড়কে মানুষের ঢল নামে। উঁচু দালান ও গাছে উঠে লোকজন খালেদা জিয়ার বক্তৃতা শোনেন। মাদ্রাসা মাঠের চারদিক ছেয়ে যায় নানা রকম ব্যানার- ফেস্টুনে। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বড় বড় প্রতিকৃতিসহ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার জামায়াতে ইসলামীর কারাবন্দী নেতা মতিউর রহমান নিজামীসহ অন্যদের মুক্তির দাবি সংবলিত ব্যানার দেখা গেছে মঞ্চের কর্মী-সমর্থকদের হাতে।সিলেট মহানগর ছাড়াও হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ জেলা থেকে বিএনপিসহ চারদলের নেতাকর্মীরা বাস-ট্রাকে করে এই জনসভায় যোগ দেন। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, বরিশাল, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে রোড মার্চের সঙ্গে এসেছেন হাজারো নেতাকর্মী। নারীদের উপস্থিতিও ছিল উল্লেখ করার মতো।