গতকাল বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের সার্কিট হাউস ময়দানের বিশাল জনসভায় ভাটি অঞ্চলের মানুষকে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, রোডমার্চের পর আর মাত্র একটি কর্মসূচি দিয়ে এ সরকারকে বিদায় করা হবে। লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ মারার হুকুম যারা দিয়েছে তাদের বিচার হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন  খালেদা জিয়া।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস মাঠে চারদলীয় ঐক্যজোট আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। খালেদা জিয়া বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আপনারা পল্টনে লগি-বৈঠার তা-ব দেখেননি? এ তা-ব কারা করেছিল এবং হুকুম কে দিয়েছিল? এগুলোর রেকর্ড আছে। লগি-বৈঠার হুকুম যারা দিয়েছিল আগামী দিনে জনগণই তাদের আসামি করবে। বিচার হবে।

তিনি বলেন, সরকারদলীয় লোকদের মুক্তি দিচ্ছে, আর বিরোধীদলীয় নেতাদের জেলে বন্দী করছে। দলীয় সরকারের অধীনে আগামীতে কোন নির্বাচন হবে না, করতে দেয়া হবে না। জনগণ জানে না, মন্ত্রীরা জানে না ট্রানজিট চুক্তি হয়েছে। ট্রানজিটের নামে করিডর দেয়া হয়েছে। এ সরকারের আর একমুহূর্ত ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। সরকার তাদের দলীয় লোকদের মুক্তি দিচ্ছে, আর বিরোধীদলীয় নেতাদের জেলে বন্দী করছে। এ সময় তিনি বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ জামায়াতের আটক থাকা শীর্ষ নেতাদের মুক্তি দাবি করেন।

লাখো মানুষের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, রোডমার্চে জনজাগরণ দেখে এই সরকারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই আবোল-তাবোল বকছে। তারা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় জনগণকে। জনগণের ভোটে তারা ক্ষমতায় আসেনি। এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে ফখরুদ্দীন-ইনউদ্দিনের দয়া এবং বিদেশের বস্তাভর্তি টাকায়। এজন্য জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। গত তিন বছরে দেশের কোনো উন্নয়ন করেনি। দেশি-বিদেশি কোনো বিনিয়োগ হয়নি। কারণ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের টেন্ডারবাজি আর জুলুমের জন্য কেউ আর এদেশে বিনিয়োগ করতে চায় না। চাঁদা দিতে দিতে ব্যবসায়ীরা শেষ।

তিনি বলেন, এই সরকার আপনাদের কাছে নির্বাচনের সময় এই মাঠেই বলেছিল জিনিসপত্রের দাম কমাবে। বলেছিল ১০ টাকায় চাল খাওয়াবে। এখন কি ১০ টাকায় চাল দেয়? দেশের মানুষ দুই বেলা পেট ভরে খেতে পায় না। তারা কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেওয়ার কথা বলেছিল। আমাদের সময় ইউরিয়া সারের বস্তা ছিল ২৬০ টাকা, এখন ১ হাজার ৬০ টাকা। বলেছিল_ ঘরে ঘরে চাকরি দেবে। কিন্তু চাকরিও দেয়নি। দেশের বেকার যুবসমাজকে ফেনসিডিল খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। এসবের বিরুদ্ধেই আমি যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। যুদ্ধের সময় তারা ওপারে পালিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ তো আমরা করেছি। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে জিয়াউর রহমান। এ সমাবেশেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আর একমূহূর্ত ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে বর্তমান সরকারকে বাধ্য করা হবে। আওয়ামী লীগ আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য হাইকোর্টের আশ্রয় নিয়ে সংবিধান সংশোধন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একমাত্র নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব। তাই দলীয় সরকারের অধীনে আগামীতে কোন নির্বাচন হবে না, করতে দেয়া হবে না।

তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেও নির্বাচন হবে না। কারণ এই কমিশন নিরপেক্ষ নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে বিদায় দিয়ে নতুন নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, একতরফাভাবে নিজেদের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
খালেদা জিয়া বলেন, সরকার ট্রানজিটের নামে ভারতের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তি করে দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে। তিনি বলেন, জনগণ জানে না, কেবিনেট জানে না, মন্ত্রীরা জানে না ট্রানজিট চুক্তি হয়েছে। ট্রানজিটের নামে করিডর দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছিল, ট্রানজিট পরীক্ষামূলকভাবে দেয়া হয়েছে। তারা দেশের ভেতর দিয়ে মালামাল নিয়ে যাবে অথচ ট্যাক্স দিবে না। কিন্তু জনগণ দেশের স্বার্থ দেখবে। ট্রানজিটের নামে করিডর বাস্তবায়ন হতে দেবে না। তিনি বলেন, সরকার বলেছিল, ট্রানজিট দিলে দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। কিন্তু এখন ট্যাক্স না পেয়ে দেশকে সিকিম বানিয়েছে।

খালেদা জিয়া আরও বলেন, সরকার গ্যাস দিতে পারে না, পানি দিতে পারে না; দেশের শিল্প কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশের হাজার হাজার ফ্ল্যাট মালিকরা গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে পারছে না। এতে করে তারা ব্যাংকের লাখ লাখ টাকা লোন শোধ করতে পারছে না। দেশে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার হাইকোর্টের আশ্রয় নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে নিজ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু তারাই এক সময় এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্য দিনের পর দিন হরতাল করে দেশের ক্ষতি করেছে। এখন তারা নিজেরাই মানছে না।

তিনি বলেছেন, নারী উন্নয়নে আমরা বিশ্বাস করি আমরা ক্ষমতায় গেলে নারীদের শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা সব ক্ষেত্রে নারীদের সম্পৃক্ত করা হবে। দেশের যুব সমাজকে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। কারণ এরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার।

সকাল থেকেই মিছিল নিয়ে জনসমাবেশ যোগ দেয় বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিএনপি, জোটের শরিক ও সমমনা দলের বিভিন্ন ইউনিট। দুুপুরের মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয় সার্কিট হাউসের বিশাল ময়দান। বেলা ১টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে চারদলের জনসভা শুরু হয়। বিকাল সাড়ে তিনটায় খালেদা জিয়া মঞ্চে উঠার আগেই জনতার ঢল মাঠের চৌহদ্দি পেরিয়ে চারপাশে জনসমুদ্রে রূপ নেয়। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ এবং চার দলের সমমনা দলসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা সভামঞ্চে ছিলেন।

ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা কমিটির সভাপতি এ কে এম মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে সমাবেশে মহাজোট সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি, দলীয়করণ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন, ভারতের সঙ্গে চুক্তি ও ট্রানজিট, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন, নির্বাচন কমিশনসহ নানা বিষয় তুলে ধরে দীর্ঘ ৫০ মিনিট বক্তব্য রাখেন খালেদা জিয়া।