পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু সংসদে প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণার পর দেশীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনুরণন সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ ভাঙিয়ে কিংবা ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন তাদের লাইফ ফান্ড বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
এদিকে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. এসএ সামাদের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়াং কিমের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং বিশেষ দূতিয়ালি নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। আজ ড. এসএ সামাদ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। এর আগে যমুনা সেতুর অর্থায়নের সময়ও ড. সামাদ অন্যতম মধ্যস্থতাকারীর দায়িত্ব পালন করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার জাতীয় সংসদে বলেন, ‘পদ্মা সেতু তৈরিতে মালয়েশিয়া প্রস্তাব দিয়েছে। পিপিপি বা অন্য যে কোনোভাবেই সেতু হতে পারে। তবে যে-ই প্রস্তাব দিক তা দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ক্ষমতায় এসে বিশ্বমন্দার মধ্যেও অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি করতে পেরেছি, পদ্মা সেতুও করতে পারব। পদ্মা সেতু করার জন্য ১৬ কোটি মানুষ আছে। দেশের বাইরে ৮০ লাখ প্রবাসী বাঙালি আছে।’ প্রধানমন্ত্রী ব্যাংকে রিজার্ভের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এক-দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করার মতো ক্ষমতা আমাদের আছে।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর দেশের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্প তৈরিতে যে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেটা কিছুটা কাটতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ব্যাপারে মুখ খুলতে শুরু করেছে। তবে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন নাকি নিজস্ব অর্থায়ন এ নিয়ে কিছুটা মতবিরোধ থাকতে পারে।
রিজার্ভের ওপর ভরসা করে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করার কথা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর। বেসরকারি খাতের বীমা কোম্পানিগুলো তাদের লাইফ ফান্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পদ্মা সেতু নির্মাণে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বর্তমান সভাপতিও শেয়ারবাজার থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থ জোগাড় করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলার ব্যয় করা যেতে পারে। এস কে সুর বলেন, আমাদের বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ ১ হাজার ৪৫ কোটি ডলারের ওপরে রয়েছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে। ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হলে রিজার্ভের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ৩ জুলাই পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের পরিমাণ ১ হাজার ৪৫ কোটি ১৪ লাখ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯০ কোটি ৯১ লাখ মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছিলেন, বেসরকারি খাতের বীমা কোম্পানিগুলো তাদের ১৬ হাজার ২৯৯ কোটি টাকার লাইফ ফান্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পদ্মা সেতু নির্মাণে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। শেখ কবির বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য সরকারি বন্ড বা অন্য কোনো তহবিলের মাধ্যমে লাইফ ফান্ডের একটা বড় অংশ কমপক্ষে ১১ হাজার কোটি টাকা এখানে বিনিয়োগ করা সম্ভব।
প্রসঙ্গত, ২৯০ কোটি ডলার ব্যয়ে পাঁচ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ এ সেতু নির্মাণে চারটি আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী সংস্থার মধ্যে বিশ্বব্যাংকই সর্বোচ্চ ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ছিল। চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকের দেওয়ার কথা ১২০ কোটি ডলার। এডিবির ৬১ কোটি ডলার, জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার ৪০ কোটি ডলার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার। বাকিটা বাংলাদেশ দেবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে। তারপরও বিশ্বব্যাংক তাদের ভাষায় ‘উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতির অভিপ্রায়ের প্রমাণ পাওয়ায়’ ঋণচুক্তি বাতিল করেছে।
গত ৩০ জুন বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। চুক্তি বাতিলের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের যুক্তি, এ প্রকল্পে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হলেও এক্ষেত্রে সরকারের যথাযথ সাড়া না মেলায় প্রকল্পের অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্টও বিদায়ী প্রেসিডেন্টের বক্তব্য সমর্থন করেছেন। বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের পর এডিবিও ঋণচুক্তি বাতিল করে।
চলতি অর্থবছরের (২০১২-১৩) বাজেটে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করার জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার একটি বরাদ্দ রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট ঘোষণার পরদিন ৮ জুন বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সাবেক অর্থ সচিব মো. তারেক বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) জন্য বরাদ্দের অর্থ পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে।