জেলা প্রশাসক তথা প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের রেশারেশির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকলেও এই ধরনের কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলে দাবি করেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেইন ভূইঞা।

তিন দিনের জেলা প্রশাসক সম্মেলন শেষে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি দ্বন্দ্বের বিষয়টি নাকচ করলেও কিছু সমস্যা থাকার কথা স্বীকার করেছেন।

“শুধু আইন দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। দীর্ঘদিন গণতন্ত্র চর্চা হলেই পর্যায়ক্রমে এসব সমস্যা দূর হবে,” বলেছেন সচিব।

তিন দিনের সম্মেলনে ২০টি কর্মঅধিবেশনে ৩৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন জেলা প্রশাসকরা। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দিক-নির্দেশনাও পেয়েছেন তারা।

সম্মেলনের শেষদিনে সমাপনী অধিবেশন ছাড়া অন্য ছয়টি কর্মঅধিবেশনে তথ্য, সংস্কৃতি এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, বস্ত্র ও পাট এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, আইন ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়।

সম্মেলনে অংশ নেওয়া জেলা প্রশাসকরা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাজনৈতিক চাপ এবং সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যাদের কারণে কাজ করতে সমস্যা, আইনের বিভিন্ন অসঙ্গতি, ডিসিদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়গুলো তারা তুলেছেন।

তবে সম্মেলনের উদ্যোক্তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব বলেন, “কোনো পর্যায়ে দ্বন্দ্বের বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়নি। তবে বিভিন্ন সমস্যার কথা আলোচনায় এসেছে। এসব সমস্যা এড়িয়ে এ পর্যায়ে কাজ করা ‘চ্যালেঞ্জিং’।”

সংসদ সদস্য ও উপজেলা পরিষদের দ্বন্দ্বের পাশাপাশি জেলা পরিষদের প্রশাসকদের সঙ্গেও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এমন কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। এ বিষয়ে আলোচনাও হয়নি। আর জেলা পরিষদগুলো এখনো সেভাবে সক্রিয় হতে পারেনি।”

প্রশাসনের বিভিন্ন কাজে রাজনৈতিক চাপের প্রসঙ্গে সচিব বলেন, “জেলা প্রশাসকরা সরাসরি কোনো হস্তক্ষেপ বা চাপের কথা বলেননি। তবে কিছু কিছু সমস্যার কথা বলেছেন।”

জেলা প্রশাসকদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার দাবি প্রসঙ্গে মোশাররাফ হোসাইন বলেন, “ডিসিরা বিচারিক ক্ষমতা চাননি। কারণ তাদের বিচারিক কিছু ক্ষমতা এখনো আছে। তারা ভ্রাম্যমাণ আদালতকে আরো কার্যকর করতে কিছু ক্ষমতা চেয়েছেন।

“কিন্তু বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর সব ক্ষেত্রে বিচারিক ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতে। এক্ষেত্রে বিধি বা আইন সংশোধন করে নতুন ক্ষমতা দেওয়ার সুযোগ নেই।”

ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষেত্রে পুলিশ না পাওয়ার কথা তুলেছেন জেলা প্রশাসকরা। তবে এক্ষেত্রে পুলিশের স্বল্পতার কথা তারা জানিয়েছেন বলে সচিব জানান।

সংক্ষিপ্ত বিচার ব্যবস্থা (সামারি ট্রায়াল) নিয়ে ডিসিদের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তারা প্রস্তাব করেছেন মাত্র। তবে সুপ্রিম কোর্টের সম্মতি ও নির্দেশনা ছাড়া এটি করা সম্ভব নয়, হবেও না। এ বিষয়ে আরো আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সম্মেলনের কোনো অধিবেশনে দুর্নীতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আলোচনা হয়নি জানিয়ে সচিব বলেন, সেবার মান বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

সম্মেলনের আলোচনা, সুপারিশ ও সিদ্ধান্ত বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, শিক্ষা নীতি বাস্তবায়ন, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ, নিবন্ধিত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়ন, এসব প্রতিষ্ঠানের মেধাবীদের আকৃষ্ট করা ও নিয়োগ, জেলা বাজেট প্রণয়ন ও কার্যকর, সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন ও বাস্তবায়নের কাজ বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে মাদকের বিস্তারের বিষয়টি। আগে সন্ত্রাসের বিষয়ে এ আলোচনায় প্রাধান্য পেত। এবার মাদকের বিষয়টি সামনে আসায় এর ব্যবহার ও অবৈধ ব্যবসা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ডিসিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

মোশাররাফ হোসেইন বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান এবং সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনা হয়েছে এর তালিকা সংস্কারের বিষয়েও।

ইট-ভাটা নিয়ন্ত্রণ, বনভূমি ও পরিবেশ সুরক্ষা, ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জনবল সঙ্কট নিরসন, মাঠ পর্যায়ে ভূমি কর্মকর্তা নিয়োগ, ভূমি জরিপ কাজে ডিজিটালাইজেশন এবং ভূমি ব্যবস্থাপনা কম্পিউটারাইজেশন, বিআরটিএ এবং বিএসটিআইকে শক্তিশালী করার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে তিনি জানান।

সচিব বলেন, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করা, রোজায় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, পাস হওয়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন এবং প্রস্তাবিত প্রতিযোগিতা আইন বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখা, কৃষিক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন ও স¤প্রসারণ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের।

চাকরি নিয়ে বিদেশে যেতে আগ্রহীদের নিবন্ধণ কার্যক্রম জোরদার, স্বাস্থ্যখাতের কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয় মালিকানা গড়ে তোলা, একই প্রশিক্ষণের পূনরাবৃত্তি ঠেকাতে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার কর্মমূখী প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সমন্বয়ও এ আলোচনায় এসেছে।

আলোচনায় এসেছে- পর্যটন শিল্পকে বিকাশে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা, নদী রক্ষা বাঁধ এবং নদী খনন কার্যক্রম তদারকি, সরকারের নীতি অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণে সহায়তা এবং ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমকে স্বচ্ছ করা, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিদ্যুৎ বিভাগকে সহায়তা এবং ই-সেবা কার্যক্রমকে শক্তিশালী করার বিষয়, তিনি বলেন।

সরকারের এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও দপ্তরগুলোকে শক্তিশালী করা না হলে জেলা প্রশাসকরা কীভাবে কাজ করবেন- জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সরকার পর্যায়ক্রমে এসব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করবে। তবে জেলা প্রশাসকদের আগে থেকেই সক্রিয়ভাবে এসব কাজ চালিয়ে যেতে হবে।