মূলত মৃত্যুই জাগিয়ে দিল হুমায়ূনকে। এ জাগরণের কোনো মৃত্যু নেই। শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার স্থানটি দখলের চেয়েও বড় জায়গা তৈরি হয়েছে তার লেখায়। হুমায়ূনই সেই লেখক, যিনি বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্প বিকাশে সেনাপতির ভূমিকায় ছিলেন। আমদানিনির্ভর ও কপিরাইট প্রকাশনা সেক্টরকে তিনি নিয়ে গেছেন একটি পরিপূর্ণ শিল্পের মর্যাদায়।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলা সাহিত্যে তিনি ছিলেন একজন ধারাবাহিক কথাসাহিত্যের দিকপাল। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতার সন্তান এ রসায়নবিদ স্বাধীনতার পরপরই লিখে ফেললেন নন্দিত নরকে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি। বাংলাদেশের বইয়ের বাজার যখন কোলকাতার লেখকদের বইনির্ভর হয়ে উঠেছিল, তখন তিনি কোলকাতার লেখকদেরও করে তুললেন ঢাকানির্ভর। সুনীলের মাধ্যমে আনন্দবাজার ও দেশ পত্রিকা পূজা সংখ্যায় নিয়ম করে ছাপতে শুরু করলো হুমায়ুনের উপন্যাস।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা সাহিত্যে তিন সেরা প্রতিভার আগমন ঘটে। তারা হলেন হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন ও মইনুল আহসান সাবের, ত্রি-রত্ন হিসেবেই যাদের পরিচিতি। বাংলা সাহিত্যের সে সময়ের সবচেয়ে বড় পাঠক ছিলেন মধ্যবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। ওই তিনজনের আগমনের আগে এ পাঠকদের রসদ জুগিয়েছেন রোমেনা আফাজ তার দস্যু বনহুর ও কাজী আনোয়ার হোসেন তার মাসুদ রানা দিয়ে। ত্রিরত্নের আবির্ভাবের পর পরই বয়সের কারণে ঝরে পড়েন প্রিয় রোমেনা আফাজ। কাজীদা টিকে ছিলেন অনেক দিন। কিন্তু বাঙালির পড়ার টেবিল থেকে মাসুদ রানা ঢুকে গেলো স্কুলগামীদের বইয়ের ব্যাগে। পড়ার টেবিলে ও ড্রয়িংরুমে জায়গা হয়ে গেল হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন এবং মঈনুল আহসান সাবেরদের।

বলতে গেলে আমার প্রজন্মের প্রায় সবার পাঠাভ্যাস তৈরিতে বড় ভূমিকা হুমাযূন-মিলন-সাবেরদের। এর মধ্যে সবার আগে ছিলেন নেত্রকোনার রাজপূত্র। আশি ও নব্বই দশকে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের রুচি বিনির্মাণে ভূমিকাও তাদের। পরে অবশ্য কি এক অজানা কারণে পিছিয়ে পড়েন মঈনুল আহসান সাবের।

স্যাটেলাইট টেলিভিশন আসার আগ পর্যন্ত বাঙালির সাংস্কৃতিক মনন গঠনেও ভূমিকা ছিলো হুমায়ূন-মিলনের। প্রতি মঙ্গলবার বিটিভিতে এক ঘণ্টার যে ধারাবাহিক দেখানো হতো, তার একটি হুমায়ূন আহমেদের, অপরটি ইমদাদুল হক মিলনের। পরে অবশ্য একধাপ এগিয়ে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা ফেলার মধ্য দিয়ে।

নাটকেও তাকেই ভাবা হতো নাম্বার ওয়ান। পাখির মুখ দিয়ে ‘তুই রাজাকার’ শব্দ বের করে হুমায়ূন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজাকারের প্রতি ঘৃণাবোধ জাগিয়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত তার শঙ্খনীল কারাগার, আগুনের পরশমনি আমাদের কৈশোরকে করেছে ঋব্ধ।

উপন্যাস-নাটক লেখায় ব্যস্ত হয়ে ওঠায় শিক্ষকতাই ছেড়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের এই অধ্যাপক। ’৮০ এর দশকে বাংলাদেশ  টেলিভিশনে প্রচারিত ‘এইসব দিনরাত্রি’ দিয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যান তিনি। এরপর বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাতের মতো জনপ্রিয় নাটকও আসে তার হাত দিয়ে।

সে এক সময় ছিল বটে। একাধারে জনপ্রিয় উপন্যাস লিখে যাচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মঈনুল আহসান সাবের। অন্যদিকে গবেষণাধর্মী উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখছেন হুমায়ুন আজাদ, আহমেদ ছফা, আজফার হোসেনরা। মাঝে মাঝেই করছেন একে অন্যের সঙ্গে বাহাস। কিন্তু হুমায়ূন বা মিলন এসব বাহাসে অংশ নিচ্ছেন না। অন্যদিকে মঞ্চ কাঁপাচ্ছিলেন নাট্যাচার্য সেলিম আলদীন, মাসুম রেজা, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, হমায়ুন ফরিদীরা।

দেশে চলছে স্বৈরাচারী শাসন। গণতন্ত্রকে গলা টিপে ধরেছে একনায়কতন্ত্র। কিন্তু হুমায়ূন বা মিলন নির্ভার হয়ে লিখে যাচ্ছেন। তারা লিখছেন মধ্যবিত্তের কোলাজ। এতে ফুটে উঠছে না রাষ্ট্রীয় কোনো সমকালীন পরিস্থিতি বা দর্শন। এসব দেখে ক্ষেপে উঠছেন হুমায়ুন আজাদ এবং আহমেদ ছফা। তবু জনপ্রিয়তার শীর্ষে হুমায়ূন।

ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক মিজানুর রহমান শেলীকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে আহমেদ ছফা হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে সমালোচনা করে বলেছিলেন, “হুমায়ূনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁদের অনেকেই তাঁর এই উন্নতি বা অবনতির জন্য অংশত আমাকেই দায়ী করতে চান। তাঁর প্রথম বই যখন বেরিয়েছিল, আমি সবচাইতে বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছি। তখন আমার মনে হয়েছিল, হয়ত হুমায়ূনের মধ্যে কালে কালে আমরা চেখভের মতো একজন প্রতিভার সন্ধান পাব। তিনি তো সে পথে গেলেন না। উপর্যুপরি সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার পরাজয় সব মিলিয়ে এখানে যে চিন্তাহীন অরাজক পরিস্থিতি হুমায়ূন সেই সময়ের প্রোডাক্ট। অবশ্য হুমায়ূনের ব্যক্তিগত কামালিয়াত এটুকু যে, তিনি পাঠকদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন। আমার প্রশ্ন, এটা কি স্থান? হুমায়ূনের পরবর্তী রচনা চানাচুরের মতো। খেতে মজা লাগে, কিন্তু পেট ভরে না এবং সার পদার্থও বিশেষ নেই।”

এমন সমালোচনা একটুও গায়ে মাখেননি হুমায়ূন আমমেদ। তিনি কেবল দায়বদ্ধ ছিলেন পাঠকের কাছে। অকাতরে লিখে গেছেন তাদের জন্য।

ওই সময় সাহিত্যের আর একটি বড় অংশ ছিল এই জনপ্রিয় ধারার লেখার বিপরীত অবস্থানে। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পও তৈরি হচ্ছিল এই নির্দিষ্ট লেখক কেন্দ্রিক। হুমায়ূন আজাদের গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, উপন্যাস নিয়ে এগিয়ে যায় ওসমান গনির আগামী প্রকাশনী। অন্য প্রকাশ বিস্তার লাভ করতে থাকে হুমায়ূনের বই ছেপে। এছাড়াও হুমায়ূনের বই ছেপেছে অবসর, কাকলী, মাওলা ব্রাদার্স। খান ব্রাদার্সই তার প্রথম বই নন্দিত নরকে প্রকাশ করে। ইমদাদুল হক মিলনের বই প্রকাশ করে মহিরূহে রূপ নেয় অনন্যা প্রকাশনী। মঈনুল হোসেন সাবেরের বই প্রকাশিত হয় তার পারিবারিক প্রকাশনী দিব্য প্রকাশ থেকে। এছাড়া সময় প্রকাশনী ও মাওলা ব্রাদার্সও প্রকাশ করে সাবেরের বই। ছফার বই এককভাবে প্রকাশ করতো খান ব্রাদার্স।

আজও ওই প্রকাশনীগুলো বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে দিকপালের ভূমিকায় আছে। যার পেছনে কাজ করেছেন এই লেখকেরা। হুমায়ূন আহমেদ যার অন্যতম। নন্দিত নরকের পর শঙ্খনীল কারাগার, রজনী, এপিটাফ, পাখি আমার একলা পাখি, ফেরা, নিষাদ, দারুচিনি দ্বীপ, নির্বাসন, অমানুষ, রূপালী দ্বীপ, শুভ্র, দূরে কোথাও, মন্দ্রসপ্তক, বাদশাহ নামদার, সাজঘর, বাসর, কবি, শ্রাবণ মেঘের দিন, তিথির নীল তোয়ালে, নৃপতির মতো পাঠক হৃদয় জয় করা উপন্যাস আসে তার লেখনীতে। এছাড়া তিনি জনপ্রিয় হিমু ও মিসির আলীর স্রষ্টা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি লিখেছেন জোৎস্না ও জননীর গল্প, ১৯৭১, সূর্যের দিনের মতো উপন্যাস। অনন্ত নক্ষত্র বীথি, ইরিনার মতো বেশ কয়েকটি বাংলা সায়েন্স ফিকশন (কল্পবিজ্ঞান কাহিনী) লিখেছেন তিনি। হুমায়ূনকে বলা চলে বাংলা সায়েন্স ফিকশনের জনক।

তাকে নিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, অনেক উৎকৃষ্ট রচনাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সস্তা চতুর্থ শ্রেণীর লেখকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।

নাটক লেখার এক পর্যায়ে নির্দেশনায়ও নামেন হুমায়ূন। নাটক নির্দেশনায় হাত পাকিয়ে নামেন চলচ্চিত্র পরিচালনায়। আগুনের পরশমনি দিয়ে শুরু করে শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামল ছায়ার মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আগুনের পরশমনি কয়েকটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল।

একটি প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ করা যায়। ইমদাদুল হক মিলন সম্পর্কে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, মিলন একটা জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। যে কোনো বইয়ের কথা বললেই ও সেটা জোগাড় করে দিত। আমেরিকায় থেকে আসার পর এ কারণেই ওর সঙ্গে আমার প্রথম বন্ধুত্ব তৈরি হয়। সেই মিলনই আবার নিয়েছিলেন হুমায়ূনের সাক্ষাতকার।

সেই সাক্ষাতকারের অংশ বিশেষ দেওয়া হলো পাঠকের জন্য।

মিলন: একটি ভিন্ন বিষয়ে আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই৷ বিষয়টি হলো ‘মৃত্যু-চিন্তা’৷ আমি জানি যে, আপনি মৃত্যু নিয়ে ভাবেন। জাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি মৃত্যু-পরবর্তী জগৎ নিয়েও আপনি ভাবেন। আপনার মৃত্যু-চিন্তাটা কী রকম?

হুমায়ূন আহমেদ: আমি থাকব না, এই পৃথিবী পৃথিবীর মতো থাকবে। বর্ষা আসবে, জোছনা হবে। কিন্তু সেই বর্ষা দেখার জন্য আমি থাকব না। জোছনা দেখার জন্য আমি থাকব না। এই জিনিসটি আমি মোটেও নিতে পারি না। আগেও কখনো পারতাম না, এখনো যতোই ওই দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততোই আর পারছি না৷

অথচ সেই মৃত্যুই আজ জাগিয়ে দিল হুমায়ূনকে। আজ যেনো স্থায়ী হয়ে গেলো বাঙালির মন ও মননে তার স্থান। তাইতো তার মৃত্যুতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যয় তাকে স্থান দিলেন অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রেরও ওপরে।
[email protected]