রাজধানীর গুলশান থানা। গত শুক্রবার ইফতারের কিছু সময় আগে থানা কমপ্লেক্স ছিল সুনসান নীরবতা। নেই কোনো ভুক্তভোগী বা সাধারণ মানুষ। ডিউটি অফিসার এসআই বোরহান রানা চেয়ারে বসে আছেন। পাশে ওয়্যারলেস অপারেটর আমজাদ হোসেন একটি প্লেটে নিজের ইফতারের সামগ্রী নিচ্ছেন। ওসি রফিকুল ইসলামের কক্ষে উঁকি দিয়ে দেখা গেল, টেবিলে কয়েকটি প্লেটে ইফতারি সাজিয়ে বসে আছেন তিনি। থানার সব কার্যক্রম যেন থেমে আছে। তবে ডিউটি অফিসারের কক্ষ হয়ে অফিসারের কক্ষের সামনে যেতেই চোখে পড়ল অন্য রকম ব্যস্ততা। থানার দুই হাজতখানাই পরিপূর্ণ। দুজন কনস্টেবল হাজতখানার আসামিদের ইফতারের প্যাকেট দিচ্ছেন। আসামিদের একজন আলমগীর বললেন, ‘পরিবার-পরিজন রাইখা থানার হাজতে ইফতার করব, তাই মনডা খারাপ। তবে পুলিশ আমাগো ইফতার দিছে, পানি দিছে। তাই একটু ভালো লাগছে। সবাই মিলে একসঙ্গে ইফতার করমু।’
ইফতারের প্যাকেট খুলে বসেছেন আসামিদের সবাই। হাজতখানার বাইরে বেঞ্চিতে বসে আছেন আরো দুজন। আবু তাহের ও মোহাম্মদ মিলন নামের দুই ব্যক্তি জানালেন, তাঁরা ভিক্ষা করেন। পুলিশের দাওয়াতেই ইফতারের জন্য তাঁরা থানায় এসেছেন। ‘আমরা ইফতার করব, আর আসামির স্বজনরা ইফতার দেবে কি না তার জন্য অপেক্ষা করব, এটা তো হতে পারে না। একটা মানবতার প্রশ্ন তো আছে। তাই আমরা নিজেরাই আসামিদের ইফতারের আয়োজন করি। নিজেরা যা খাই, ওদেরও তা-ই দিই’_হাসিমুখে কথাগুলো বললেন থানার অপারেশন অফিসার আবু বকর সিদ্দিক। তিনি হাজতখানার সামনে দাঁড়িয়ে আসামিদের ইফতার দেওয়ার কাজটি তদারকি করছিলেন। শুক্রবার গুলশান থানার হাজতখানায় ইফতার করলেন ২১ জন আসামি। ছিলেন দুজন ভিক্ষুকও। মনে কষ্ট থাকলেও থানা হাজতে পুলিশের পক্ষ থেকে ইফতার পেয়ে তাঁরা সন্তুটিই প্রকাশ করলেন।
আলাপচারিতার মধ্যেই গুলশানের আজাদ মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি কানে ভেসে এলো। গুলশান থানা ভবনের দোতলার মসজিদেও আজান হচ্ছিল। ইফতার শুরু করলেন হাজতখানার আসামিরা। পানি, খেজুর, ছোলা, চপ, পেঁয়াজু, বেগুনি, জিলাপি, আপেল, মাল্টা, মুড়ি ও শসা। এক হাজতখানায় ৯ জন আসামি। অপরটিতে ১২ জন। মাকসুদুর রহমান নামের এক যুবক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘রোজার মধ্যে গ্রেপ্তার হইলাম। কোনোদিন জেলে ছিলাম না ভাই। স্পেনে যাওয়ার জন্য এম্বাসিতে আইছিলাম। সেখানে গ্রেপ্তার হইলাম। আমাগো নাকি কাগজপত্র জাল।’
কয়েকজন আসামি জানালেন, গত বুধবার স্পেনে যাওয়ার ভিসা নিতে গিয়ে তাঁরা ১৬ জন এম্বেসির সামনে থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। সবার বাড়ি কুমিল্লায়। পুলিশ তাদের দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে এসেছে। মীর হোসেন নামের একজন বললেন, ‘জাল কাজগপত্র থাকায় পুলিশ আমাগোরে ধরছে। কিন্তু আমরা এসব কিছু জানি না। বিদেশে যাইতে গিয়া রমজানের মধ্যে থানায় পইরা আছি।’ তবে কয়েকজন আসামি বলেন, মীর হোসেনের ভগ্নিপতি মাসুদ করিম স্পেনের মাদ্রিদে থাকেন। তিনিই বিদেশে নেওয়ার জন্য আমাদের ওয়ার্ক পারমিট পাঠান। ওই ওয়ার্ক পারমিট জাল বলে অভিযোগ করেছে স্পেন এম্বেসি।
বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গিয়ে থানায় ইফতার করা কয়েকজনের ভিড়ে পাওয়া গেল বাড্ডার নতুন বাজার এলাকার এক তরুণকে। মাসুদ নামে ওই তরুণ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি কসমেটিকের দোকান করি। আমি নাকি একজন বিদেশির মোবাইল চুরি করছি। দেখেন, আমি কিছু জানি না। রমজানের মধ্যে থানায় পড়ে আছি…।’
মোহাম্মদ সেলিম নামে এক আসামি বলেন, গুলশানের ২১৪ নম্বর রোড থেকে একটি মারামারির ঘটনায় পুলিশ আমাকে আটক করেছে। সেলিমের মুখে আঘাতের চিহ্ন। ইফতারের ফাঁকে রসিকতার সুরে হেসে বলেন, ‘পুলিশের ইফতার খেয়ে ভালাই লাগছে।’
হাজতখানার কক্ষের সামনে বসে ইফতার করছিলেন কনস্টেবল আনিসুর রহমান। পাশের অফিসারদের কক্ষে ডিউটি অফিসার বোরহান, এসআই সোহেল রানাসহ আটজন ইফতার খাচ্ছিলেন। এসআই বোরহান বলেন, ‘ইফতারের সময় থানায় সবাই থাকেন না। যারা থাকেন তাঁরা সবাই একসঙ্গেই ইফতার করেন। সবাই একসঙ্গে ইফতার কিনে ভাগ করে খাই। বাইরের লোকজন থাকলে তাদের খাওয়াই। আসামিদের খাওয়াই। এটা একটা আনন্দমুখর পরিবেশ।’
ওসির কক্ষে রফিকুল ইসলাম, অপারেশন অফিসার আবুবকর সিদ্দিক ও এসআই মতলেবুর রহমান ইফতার করছিলেন। আয়োজন প্রায় একই। ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘থানায় আসলে পুলিশের জন্য ইফতারের কোনো আলাদা বরাদ্দ নেই। আমরা তো সবাই ইফতার করি। নিজেদের খরচেই করি। আর আসামিদের রেখে নিজেরা ইফতার তো করা যায় না। এখানে আসামির স্বজনরাও মাঝেমধ্যে ইফতার দেয়। তবে হাজতে যত আসামি থাকে তাদের জন্য আলাদাভাবে ইফতার কিনে আনা হয়।’ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রমজানের বড় শিক্ষা হচ্ছে, সহমর্মিতা, ত্যাগ, মানবতাবোধ। এগুলো নিয়েই আমরা আছি। তাই ইফতারে পুলিশ আর আসামি কেন আলাদা হবে?’
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, সব সময় থানায় এত আসামি না থাকলেও এক মামলায় ১৬ আসামির কারণে হাজতখানা এখন পরিপূর্ণ। গত বুধবার স্পেন এম্বেসি কর্তৃপক্ষের দায়ের করা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করে দুই দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। এক প্রতারকের মাধ্যমে তাঁরা ওয়ার্ক পারমিটসহ প্রয়োজনীয় নথিপত্র জাল করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া এক আসামিকে দুই দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে এক অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের মোবাইল ফোন চুরির মামলায়। বাকিরা মারামারির অভিযোগে আটক রয়েছেন।