সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির ব্যবহূত পোশাক, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত চাকু ও অন্যান্য আলামত থেকে শনাক্ত করা পৃথক ডিএনএ’র মধ্যে সাদৃশ্য পাওয়া গেছে। এতে একই ব্যক্তি দু’জনকে হত্যা করতে পারে বলে একটি প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিএনএ পরীক্ষায় এটি আরও একধাপ এগিয়ে গেল। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন হাতে পেলে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা যাবে। এদিকে গত মঙ্গলবার সাংবাদিক দম্পতির একমাত্র সন্তান মাহিন সরওয়ার মেঘের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য তার মুখের লালা সংগ্রহ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওই পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল জানান, ডিএনএ পরীক্ষা তদন্তের একটি অংশ মাত্র। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তা কিছু প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে সমানতালে ম্যানুয়াল ও প্রযুক্তিগত তদন্ত চলছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অন্তত ছয়টি মাধ্যমে সাগর-রুনির তদন্ত চলছে। এগুলো হল-সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ, তদন্তে প্রযুক্তির ব্যবহার, সোর্স নিয়োগ, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসী বা প্রফেশনাল কিলারদের সম্পৃক্ততা, ফরেনসিক বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা অনুসন্ধান। এর মধ্যে ফরেনসিক অংশটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে ফরেনসিকের আওতাধীন ডিএনএ টেস্ট, ফুট ও ফিঙ্গার প্রিন্ট, ক্রাইম সিন বিশ্লেষণ, ভিসেরা প্রতিবেদন, ডেডবডি মুভমেন্ট ইত্যাদি বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ডিএনএ পরীক্ষা হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত লোকজনের একটি প্রাথমিক প্রমাণ মাত্র। এই ডিএনএ দিয়ে সন্দেহভাজনদের ডিএনএ’র সঙ্গে মিল পাওয়া গেলে তাদের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এভাবেই প্রকৃত খুনি ও খুনের মোটিভ উদঘাটন করা সম্ভব বলে ওই সূত্র দাবি করে।
র্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত ১২ জুন ও ১৭ জুলাই দুই দফায় সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা নয়টি আলামত যুক্তরাষ্ট্রে ফরেনসিক ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এসব আলামতের মধ্যে রয়েছে একটি ছুরি, একটি ছুরির বাঁট, সাগর ও রুনির রক্তমাখা জামা-কাপড়ের অংশ, সাগরের হাত-পায়ে বাঁধা দড়ির অংশ, সাগরের মোজা ও একটি কম্বল। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ওই গবেষণাগার থেকে রুনির রক্তমাখা জামা-কাপড় থেকে যে ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া গেছে তার সঙ্গে সাগরের শরীরে বিদ্ধ ছুরির বাঁট ও অন্যান্য আলামত থেকে পাওয়া ডিএনএ প্রোফাইলের সাদৃশ্য রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার আগে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না র্যাব কর্মকর্তারা। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এই প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার কথা রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, র্যাবের হাতে তদন্তভার স্থানান্তরের পর অন্তত ৯৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র্যাব। এদের মধ্যে অধিকতর সন্দেহভাজন হিসেবে একটি ‘শর্ট লিস্ট’ তৈরি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর সন্দেহভাজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আলামত থেকে পাওয়া ডিএনএ’র সঙ্গে ম্যাচিং করে দেখা হবে। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট র্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আলামত থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ’র সঙ্গে সন্দেহভাজনদের ডিএনএ মিলিয়ে দেখার জন্য কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হচ্ছে। কারও ডিএনএ’র সঙ্গে মিল পাওয়া গেলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার পূর্বাপর তথ্য সংগ্রহের পরই তাকে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হবে।
এদিকে নিহত মেহেরুন রুনির ছোট ভাই ও মামলার বাদী নওশের আলম রোমান জানান, ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে যা করা হচ্ছে তাতে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। তবে সবশেষে কী হবে তা নিয়ে এখনও সন্দিহান তারা। পরিবারের ভাষ্য, যে কোনোভাবেই হোক তারা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন দেখতে চান। হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারাটাই মূল কথা বলে মন্তব্য করেন তারা।
নওশের আলম রোমান বলেন, র্যাব কর্মকর্তারা তাদের নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে যে মন্তব্য করেছেন তাতে তারা রীতিমতো বিস্মিত হয়েছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হচ্ছে। এমনকি যেদিন এই বৈঠক হয়েছে তার আগের দিনও র্যাবের এক কর্মকর্তা তার সঙ্গে চার ঘণ্টা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সংসদীয় কমিটির কাছে এই অভিযোগ করায় তারা মামলার ভবিষ্যত্ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করছেন।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে পশ্চিম রাজাবাজারের বাসা থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এদিন দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করা হবে বলে ঘোষণা দেন। এরপর পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার পুলিশ সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু এরপরও কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গত ১৮ এপ্রিল মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ আদালতে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে। পরে উচ্চ আদালত ওই দিনই র্যাবকে মামলার তদন্ত করার নির্দেশ দেন। তদন্তভার পাওয়ার পর গত ২৬ এপ্রিল ভিসেরা পরীক্ষার আলামত সংগ্রহের জন্য দু’জনের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়।