প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে বৈঠকে বসার প্রয়োজনীয়তা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিএনপি নেতার এখন একটাই দাবি_ তার দুর্নীতিগ্রস্ত ছেলেদের মুক্তি। সেইসঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ এবং দুর্নীতি ও বিদেশে অবৈধভাবে অর্থ পাচারের মামলা প্রত্যাহার। তাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্যও অভিন্ন। তাই তাদের সঙ্গে বৈঠকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি না। বাসস।
শনিবার জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রাখেন, তাহলে কি কোনো রাজনৈতিক শক্তির অবৈধ স্বার্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যাবে না? দুর্নীতিবাজরা ছাড়া পাবে? গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না? এতিমদের টাকা মেরে খাওয়ার কোনো প্রতিকার হবে না?তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকাল মাত্র ১০/১১ বছর। দেশের উন্নতি এবং মানুষের কল্যাণে যা হয়েছে তা আওয়ামী লীগের আমলেই হয়েছে। সরকার পরিচালনার নামে অন্যরা দেশের সম্পদ লুটেপুটে খেয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস, প্রধানন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার স্বপন সাহা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বক্তব্যের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে তার ১১ দিনব্যাপী সফরের বিভিন্ন কর্মসূচি তুলে ধরেন। জাতিসংঘ মহাসচিব ও ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামার দেয়া ভোজসভায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওবামা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চান এবং এদেশ সফরে আসার আগ্রহ ব্যক্ত করেন।প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রধানমন্ত্রীকে জানান, দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে তার মাথার চুল পেকে যাচ্ছে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেন, এটা তো প্রথম মেয়াদ, তাই এখনো কিছু চুল কালো দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় মেয়াদে এগুলোও পেকে যাবে।শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার বাংলাদেশ বিমানের ঢাকা-নিউইর্য়ক ফ্লাইট পুনরায় চালু করায় জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। আমারও আজ সেই সুযোগ হয়েছে একই দিনে এই বিশ্বসভায় বাংলায় বক্তৃতা করার। এজন্য তিনি মহান আল্লাহতালার কাছে অশেষ শুকরিয়া আদায় করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘের কাজ এখন শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমরা জাতিসংঘকে আরো কার্যকর সংস্থা হিসেবে দেখতে চাই। আমরা সংঘাতপূর্ণ বিশ্ব চাই না। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব রেখে যেতে চাই। এতেই পৃথিবীতে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। এজন্য জাতিসংঘকে আরো তৎপর হতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘে ৬৬তম সাধারণ অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে ‘শান্তির মডেল’ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, তার উলি্লখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করলেই পৃথিবীতে শান্তি আসবে। তিনি বলেন, তার সরকার শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার সরকার জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস বা মালিক করতে চায়। ‘জনগণই তার ক্ষমতার মূল শক্তি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণই তাদের ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে কারা দেশ চালাবে।
দেশের অর্থনীতি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে। তবে দারিদ্র্য নির্মূল করতে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক সমাজ ও অর্থ ব্যবস্থায় কোনো দেশ একা চলতে পারে না। তাই আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সকল প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক সফরের সময় নেপাল ও ভুটানের দাবি অনুযায়ী ভারত ট্রানজিট দিতে রাজি হয়েছে। ওই সফরের সময় এঅঞ্চলে জলবিদ্যুৎ নিয়ে সহযোগিতার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, দুদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রয়েছে। ৫৪টি নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে দুদেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, আলোচনা চলছে, তবে কে কতটুকু পানি পাবে তা নির্ধারণ করতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। এজন্য একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি করা যায় কি না তা নিয়ে আলাচনা চলছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা গঙ্গার পানিবণ্টনের মতো একটি জটিল সমস্যা যখন সমাধান করতে পেরেছি তখন ইনশাল্লাহ তিস্তা চুক্তিও হবে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে গণতন্ত্রের দুরবস্থার বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে একমাত্র আমরাই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলাম। আর কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে বিএনপি ২০০১ সালে দেশে যে নৈরাজ্য করেছে তা সকলেই জানে। তারপরও তারা কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতা অাঁকড়ে থাকতে চেয়েছিল। তাদের সেই ক্ষমতালিপ্সার কারণে ১/১১’র সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে।শেখ হাসিনা ১/১১-এর পরবর্তী ঘটনাবলি তুলে ধরে বলেন, এবারো অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে কেউ যাতে এ অধিকার ছিনিয়ে নিতে না পারে সে জন্য সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না বলে বেগম জিয়ার মন্তব্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সময় এলে দেশে নির্বাচন হবে এবং ওই নির্বাচনে সকল দল অংশ নেবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। সরকার কখনো নির্বাচন কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। জনগণ যাকে ভোট দেবে সে দল ক্ষমতায় আসবে।তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে অবস্থান ব্যাখ্যা করে শেখ হাসিনা বলেন, এ ধরনের একটি সরকারের জন্য আমরাই প্রথম আন্দোলন করেছি। বিএনপি তা চায়নি। তাদের মতে পাগল ও শিশু ছাড়া দেশে কোনো নিরক্ষেপ লোক নেই। তারপর বাধ্য হয়ে মধ্যরাতে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করেছিল।
পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করি। কিন্তু বিচারপতি লতিফুর রহমান শপথ গ্রহণের আধাঘণ্টার মধ্যেই ১৩ জন সচিবকে চাকরিচ্যুত করেন। তখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্য উপদেষ্টাদের নিয়োগ পর্যন্ত হয়নি, কেবিনেটের কোনো বৈঠকও হয়নি। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আমরা ভোট পেলাম বেশি কিন্তু আসন পেলাম কম। ২০০৭ সালেও বিএনপি নিজের করা আইন ভঙ্গ করে রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সকল কুশীলবই ছিল বিএনপির সৃষ্টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা ভেবেছিল তাদের দিয়ে লুণ্ঠিত অর্থ পাচার সম্ভব হবে। তারা ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগেও অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে চায়নি। কিন্তু হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, উচ্চ আদালত যাকে অবৈধ রায় দিয়েছে আমরা তাকে কীভাবে বৈধ করবো?প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে বিদেশের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হয়নি বলে তার দলকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, ক্ষমতার লোভে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়ার রাজনীতি শেখ হাসিনা করে না।
বিএনপির আন্দোলন কখনোই সফল হবে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের জনগণ দুর্নীতিবাজদের পক্ষে দাঁড়াবে না। কাজেই তারা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। তিনি আন্দোলনের নামে জনগণকে কষ্ট না দেয়ার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানান।