ঈদ উদযাপনে গ্রামের বাড়ি ছুটছে মানুষ। ফাঁকা হতে শুরু করেছে রাজধানীর রাস্তাঘাট। যানজট এখন দানা বাঁধতে শুরু করেছে মহাসড়কে। ঢাকায় শুধু মার্কেট ও বাস, ট্রেন, লঞ্চ স্টেশন এলাকায় জট রয়েছে। এসব এলাকাও আর দুয়েক দিনের মধ্যে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়বে। ঈদে ঢাকা ছেড়ে নাড়ির টানে গ্রামে ফেরা অসংখ্য মানুষের নজর এখন রাস্তাঘাটের দিকে। ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসছে মহাসড়কে ততই ভিড় বাড়ছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে চলাচল। এদিক লক্ষ রেখে  দেশের আট হাজার কিলোমিটার সড়কের নিরাপত্তায় হাইওয়ে পুলিশের কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে মাঠে নামানো হয়েছে র্যাব ও সংশ্লিষ্ট এলাকার থানা পুলিশকে। গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লায় ৪০ কিলোমিটার জুড়ে দেখা দেয় ভয়াবহ যানজট। এ ছাড়া ঢাকা-মাওয়া, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কেও তীব্র যানজট ছিল। এদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে তেমন বড় ধরনের যানজট না থাকলেও গাবতলী থেকে যাত্রা শুরুর সময় গাড়ি চলেছে ধীরগতিতে। বিঘ্নিত হয়েছে চলাচল। অন্যদিকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে যাত্রীর ভিড় বাড়ায় পদ্মায় লঞ্চে ঝুঁকিপূর্ণ চলাচলের খবর পাওয়া গেছে।
পুলিশ জানায়, হাইওয়ে পুলিশের একটি ফাঁড়ি থেকে আরেকটি ফাঁড়ির দূরত্বও অনেক। ৬০ কিলোমিটার থেকে শুরু করে তার চেয়ে বেশি দূরত্বে প্রতিটি ফাঁড়ির অবস্থান। এ জন্য অনেক স্থানে পুলিশের টহল নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশ তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এ জন্য কোনো কোনো স্থানে ঘরমুখো মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের প্রায় আট হাজার কিলোমিটার হাইওয়েকে পূর্বাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চলে ভাগ করে সাতটি জোন তৈরি করে প্রতিজোনে একজন এএসপির নেতৃত্বে কাজ চলছে। সিনিয়র কর্মকর্তারা কাজের তদারকি করছেন। পরিবহন মালিক, শ্রমিক, চালকদের কাছে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি এবং কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোন নম্বর পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সড়কের স্থান নির্বাচন করে চেকপোস্ট বসিয়ে স্ট্রিট ডিটেক্টর ও ভিডিও ক্যামেরার সাহায্যে  যানবাহনের চিত্র ধারণ করা হচ্ছে। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমেও কিছু পয়েন্টে দুর্বৃত্তদের কর্মকাণ্ড ধারণ করা হচ্ছে। তবে  হাইওয়েতে কাজ করতে গিয়ে পুলিশ  সদস্যরা চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পূর্বাঞ্চলকে সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও গাজীপুর জোনে এবং পশ্চিমাঞ্চলকে বগুড়া, কুষ্টিয়া ও গৌরনদী জোনে ভাগ করে আট হাজার কিলোমিটার সড়কে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৪শ’ ৭৬ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক এবং চার হাজার ১শ’ ৬৫ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক রয়েছে। এসব সড়কে ৪৮টি ফাঁড়িতে আড়াই হাজার পুলিশ কাজ করছে। প্রতিটি ফাঁড়িতে ২২ থেকে ২৪ জন করে পুলিশ কাজ করছে। পণ্যবাহী পরিবহনে যাতে কোনোভাবেই চাঁদাবাজি না হয় এবং যাত্রীবাহী বাসে ডাকাত হানা দিতে না পারে সে জন্য ফাঁড়ির কর্মকর্তাদের বিশেষ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চাঁদাবাজি, ডাকাতি ছাড়াও মাদক পরিবহন ও চোরাচালান বন্ধ এবং
সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে হাইওয়ে পুলিশকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।
সূত্র জানায়, ঈদে ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় যেতে মহাসড়কের আমিনবাজার থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সড়কে যানজট হচ্ছে। গাবতলী থেকে আমিনবাজার, নবীনগর, সাভার, বাইপাইল ও চন্দ্রা এই কয়েকটি স্থানে যত্রতত্র বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করানোর ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়। ঢাকা-পাটুরিয়া মহাসড়ক, মানিকগঞ্জ, মাওয়া ঘাট, কাঁচপুর, দাউদকান্দি, আশুলিয়া, বাইপাইল, জয়দেবপুরসহ অন্তত ১০টি পয়েন্টকে অধিকতর যানজটপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশ আগেভাগেই কাজ শুরু করেছে।
হাইওয়ে সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ঈদের আগেই উত্তরাঞ্চলের মানুষ যেন নির্বিঘ্নে বাড়ি যেতে পারে এ জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে। মহাসড়কের দু’দিকে অস্থায়ী বাজারগুলো উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, এ বছর ঈদের আগে দীর্ঘ ছুটির কারণে মানুষ আগে থেকেই বাড়িতে যেতে পারছে। ফলে রাস্তাঘাটের চিত্র কিছুটা ভালো। তবুও কোনো কোনো স্থানে বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া গেছে।
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার কোরপাই ও নাজিরাবাজার এলাকায় পৃথক দুটি স্থানে গতকাল একটি লরি উল্টে ও অপর একটি লরি বিকল হয়ে রাস্তার ওপর পড়ে যায়। এতে দু’দিকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় কুমিল্লার ৪০ কিলোমিটার জুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। হাইওয়ে ময়নামতি থানার এসআই সিরাজুর ইসলাম জানান, গতকাল সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি লরি জেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বুড়িচং উপজেলার কোরপাই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে রাস্তার ওপর পড়ে যায়। এতে মহাসড়কের দু’দিকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। খবর পেয়ে সকাল ৯টায় একটি রেকার দিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত লরিটি রাস্তার ওপর থেকে সরিয়ে নিলে দুপুর ১২টার দিকে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। এদিকে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে মহাসড়কের ময়নামতি সেনানিবাস সংলগ্ন নাজিরাবাজার এলাকায় রড বোঝাই অপর একটি লরি বিকল হয়ে রাস্তার ওপর পড়ে থাকলে মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এ সময় ঈদে ঘরমুখো মানুষকে দারুণ দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়। রেকার ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তত্পরতা চালিয়ে বিকল হওয়া লরিটি উদ্ধারে ব্যর্থ হয়। এ সময় যানজট আরও তীব্র আকার ধারণ করে। গাড়ির লম্বা সারি তখন পশ্চিমে দাউদকান্দি টোল প্লাজা থেকে পূর্বে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাস এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বেলা ২টায় বিকল্প ব্যবস্থায় বিকল লরিটি মহাসড়ক থেকে সরিয়ে নেওয়া হলে পুনরায় রাস্তায় যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটের মাদারীপুরের কবুতরখোলা টার্নিং চ্যানেলে মঙ্গলবার রাত ১০টায় ডুবোচরে আটকে পড়া কেটাইপ ফেরি কাকলি দীর্ঘ আট ঘণ্টা পর গতকাল সকালে উদ্ধার করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ফেরি মাঝ পদ্মায় নোঙর করে রাখা হয়। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সাড়ে সাত ঘণ্টা একই স্থানের ডুবোচরে রো রো ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ২৭টি যানবাহন নিয়ে আটকে ছিল। এই ফেরি উদ্ধারের মাত্র চার ঘণ্টার ব্যবধানে রাত ১০টায় ওই ডুবোচরে আবারও কাকলি নামে অন্য একটি কে টাইপ ফেরি আটটি যানবাহন নিয়ে আটকে পড়ে। এদিকে ফেরি পারাপার ব্যাহত হওয়ায় ঈদে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা অভিমুখী যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কে টাইপ ফেরি কাকলির মাস্টার ইন চার্জ মো. ইয়াকুব আলী বলেন, নদীতে অসংখ্য ডুবোচর জেগেছে।
রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগের অন্যতম নৌপথ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া দিয়ে লঞ্চে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এ কারণে পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে বর্ষা মৌসুমে ভরা পদ্মায় অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে হচ্ছে ঘরমুখো মানুষকে। লঞ্চ মালিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে যাত্রী পরিবহনের জন্য ৩৬টি লঞ্চ রয়েছে। এর মধ্যে আরিচা-নগরবাড়ী রুটে চলে দুটি লঞ্চ।
আরিচা-নগরবাড়ী নৌরুটে ঈদের এই সময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যাত্রীদের চাপ পড়ায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুট থেকে আরও ১০টি লঞ্চ পাঠানো হয়েছে আরিচা-নগরবাড়ীতে।