পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে চলছে আলো-আঁধারির খেলা। হতাশা ছাপিয়ে আশার আলো ঠিকরে পড়তে না পড়তেই অনিশ্চয়তার নতুন মেঘে ঢেকে যাচ্ছে তা। এভাবে মুহূর্তে মুহূর্তে বদলাচ্ছে দৃশ্যপট। দু’দিন আগে অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগ গুজব ছিল। আগের দিন পদত্যাগে আপত্তি নেই বলার পরও গতকাল ওই গুজব উধাও হয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পদত্যাগের নতুন গুজব। তবে গতকাল রাত পর্যন্ত এ ধরনের কিছু ঘটেনি।


গতকাল বিকেলে অর্থমন্ত্রীর মুখ থেকে বরং বেরিয়েছে নতুন অভয় বাণী। সচিবালয়ে উদগ্রীব সাংবাদিকদের  তিনি জানিয়েছেন, বুধবার পদ্মা সেতু বিষয়ে বিবৃতি দেবেন। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘টেনশনের কোনো কারণ নাই।’ তবে এর মধ্য দিয়ে তিনি তার পদত্যাগ বিষয়ে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন, না কি পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন-তা ধোঁয়াশাপূর্ণই থেকে গেছে। বিবৃতি দিতে দু’দিন সময় নেওয়ায় সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ নতুন আশার আলো দেখছেন। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে চূড়ান্ত উত্তরের আশায় এই সময় নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে সংস্থাটির সঙ্গে সমঝোতার সর্বশেষ চেষ্টা করা হবে।


বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন শর্ত পূরণের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সংস্থাটির ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। শুধু অবশিষ্ট একটি শর্ত পরিপালন করলেই বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। এ শর্তটি হচ্ছে  প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগ। কিন্তু এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও সরকার সুস্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বিষয়টি নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীও বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। যদিও মসিউর রহমানের পদত্যাগ না করার দিকেই অবস্থানের পাল্লাটি ভারি। তবে গতকালও পদ্মা সেতু ইস্যুতে নীতিনির্ধারকরা ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। এদিন অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রীর সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে।


অন্যদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর সেতু ভবনে মালয়েশিয়ার বিশেষ দূত এস সামি ভেলু পদ্মা সেতু নির্মাণে তাদের চূড়ান্ত প্রস্তাবের একটি অনুলিপি যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে হস্তান্তর করেন।


দিনভর গুজব : আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে ফিরে বিষণ্ন অর্থমন্ত্রী নিজেকে একপ্রকার গৃহবন্দি করে ফেলেন। তিনি সেদিন অফিস করেননি। দিনের সব কর্মসূচিও বাতিল করেন। জানা যায়, অর্থ উপদেষ্টার পদত্যাগ ইস্যুতে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে কনভিন্স করতে ব্যর্থ হয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি জানিয়েছিলেন, বিষয়টি চূড়ান্ত সমঝোতার কাছাকাছি চলে এসেছে। অর্থ উপদেষ্টা পদত্যাগ করলেই বাকি আনুষ্ঠানিকতা সেরে নেওয়া যায়। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেন, মসিউর রহমান পদত্যাগ করলে অর্থায়ন করা হবে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এমন নিশ্চয়তা নিতে। এসবের ভিত্তিতে গতকালও অর্থমন্ত্রী ছিলেন বেশ বিষণ্ন। সব মিলিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে তিনি পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। তার আগে একটি বিবৃতির মাধ্যমে পদ্মা সেতু ইস্যুতে পূর্বাপর ঘটনাবলি ও তার অবস্থান তুলে ধরবেন।


পদত্যাগ করছেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে মসিউর রহমান রোববার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকারের ভাষ্য আগে আসা উচিত। সরকারের ভাষ্য দেবেন অর্থমন্ত্রী।’ গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়ে নিজ কার্যালয়ে প্রবেশের মুখেই অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয় অর্থমন্ত্রীকে। কিন্তু তিনি না দাঁড়িয়ে কয়েকটি কথা বলে নিজ কক্ষে প্রবেশ করেন। মসিউর রহমানের পদত্যাগ ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আই অ্যাম নট রেডি। এ বিষয়ে আমি স্টেটমেন্ট দেব।’ ‘নানা কথা শোনা যাচ্ছে’-এমন মন্তব্য করে এক সাংবাদিক অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুনতে থাকুন।’


২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণ সুবিধা দেওয়ার চুক্তি করেছিল সরকারের সঙ্গে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সেতুর পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ তোলে সংস্থাটি। এ অবস্থায় ঋণ পেতে সরকারকে কয়েকটি শর্ত দেয় বিশ্বব্যাংক। সরকার সাড়া না দেওয়ায় গত জুনে অর্থায়ন চুক্তি বাতিল করে তারা। তবে অর্থায়ন বাতিলের পর এই প্রকল্প নিয়ে অভিযোগের মুখে থাকা মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন। সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসাইনও ছুটিতে যান। মালয়েশিয়ার চূড়ান্ত প্রস্তাব : গতকাল পদ্মা সেতু নির্মাণের চূড়ান্ত প্রস্তাব দিয়েছে মালয়েশিয়া। এখন বাংলাদেশ রাজি হলেই চূড়ান্ত চুক্তি হবে। প্রস্তাব পাওয়ার পর যোগাযোগমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটি কারিগরি কমিটি প্রস্তাবের খুঁটিনাটি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্থার কাছে এর সুপারিশমালা উপস্থাপন করবে।’


এই অর্থবছরের মধ্যেই নির্মাণকাজ শুরু হবে বলে আশা প্রকাশ করলেও মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে সরকার কবে সিদ্ধান্ত নেবে সে বিষয়ে কোনো কিছু বলেননি ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘এই প্রস্তাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত শর্তাবলি নিয়ে বাংলাদেশ আলোচনা করবে।’ মন্ত্রী বলেন, চুক্তি সই হলে নির্মাণ, মালিকানা, পরিচালনা ও হস্তান্তরের (বিওওটি) ভিত্তিতে সেতু নির্মিত হবে এবং মালয়েশিয়ার এক্সিম ব্যাংক এটির শীর্ষ উদ্যোক্তা হিসেবে থাকবে।