লঞ্চ, ট্রেন ও বাসে দুর্ভোগ। তারপরও পথের ক্লান্তি ভুলে ঈদ উদযাপনে বাড়ি ফিরছে মানুষ। সরকারের আশ্বাসের পরও মহাসড়কগুলোতে যাত্রী ভোগান্তি কমেনি। ঠিকমতো সংস্কার হয়নি বেহাল সড়কগুলো। ধীরে চলছে গাড়ি। তারপরও সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতকাল ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কেও যানজট ছিল তীব্র। অন্যদিকে লঞ্চের ছাদে চড়তে কর্তৃপক্ষের নিষেধ থাকলেও কেউ মানছে না সে নির্দেশ। গতকালও অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই করে রাজধানীর সদরঘাট থেকে ছেড়ে গেছে প্রায় সব লঞ্চ। টিকেট না পেয়ে বাধ্য হয়েই ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চের ছাদে চড়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে বলে জানান একাধিক লঞ্চযাত্রী।
গতকাল সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে সদরঘাটে দক্ষিণাঞ্চলগামী ঘরেফেরা মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। দুপুরের পর টার্মিনালের কোথাও তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। বড় বড় লাগেজ নিয়ে বাড়িফেরা মানুষগুলোর ভোগান্তির যেন শেষ নেই। লঞ্চে টিকেট না পেয়ে অনেককেই চরম হতাশ হতে দেখা গেছে। আবার কেউ কেউ কালোবাজারিদের কাছ থেকে দ্বিগুণ দামে টিকেট কিনে ঘরে ফেরার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন। এতসবের পরও সবারই মুখে ছিল বাড়ি ফেরার আনন্দ।
লঞ্চমালিকদের সংগঠন অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন মিলন জানান, প্রতিদিন ৮০ থেকে ৮৫টি লঞ্চ
সদরঘাট থেকে বিভিন্ন রুটে ছেড়ে যাচ্ছে। যাত্রীদের চাহিদামতো লঞ্চ রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এবার সরকারি ছুটি ঈদের পাঁচ দিন আগে থেকে শুরু হওয়ায় যাত্রীদের চাপ অন্য বছরের তুলনায় কিছুটা হলেও কম। যাত্রীবোঝাই হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লঞ্চ ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ছাদে যাত্রীবোঝাই করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাত্রীরা জোর করেই ছাদে উঠে যাচ্ছে। লঞ্চের স্টাফরা তাদের নামাতে গেলে মারামারি বেধে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। তাই জোর করে যাত্রীদের নামানো হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে নিজেদের অসহায় দাবি করে মিলন জানান, ১৪ আগস্ট থেকে যাত্রীদের চাহিদা মেটাতে অনেক লঞ্চ প্রতিদিন ডবল ট্রিপ দিতে শুরু করেছে।
এদিকে লঞ্চের ডেক ও কেবিনের টিকেট কালোবাজারি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সদরঘাট টার্মিনালে আসা যাত্রীদের অনেকে। তাদের অভিযোগ, কাউন্টারে টিকেট নেই। তবে কয়েকগুণ বেশি দাম দিলেই দালালদের কাছে টিকেট পাওয়া যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। কামাল নামে বরিশালের এক যাত্রী অভিযোগ করেন, দ্বিগুণ দাম দিয়ে টিকেট কিনে ডেকে বসে বাড়ি যাচ্ছেন তিনি। কেবিনের টিকেটও নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি টাকায় কিনতে হয়েছে অধিকাংশ যাত্রীকে। যারা ডেক ও কেবিনের টিকেট পাননি তারা বাধ্য হয়েই ঝুঁকি নিয়ে ছাদে উঠছেন। লঞ্চের কোথাও জায়গা না পেয়ে ছাদে উঠেছেন মোহাম্মদ আলী নামে এক যাত্রী। তিনি জানান, টিকেট না পেয়ে লঞ্চের স্টাফদের সহায়তায় ছাদে উঠেছেন তিনি।
এদিকে রেল ও সড়ক পথের যাত্রীদেরও দুর্ভোগের অন্ত নেই। মহাসড়কে যানজটের কারণে গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগছে দ্বিগুণ। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের একাধিক বাসচালক জানান, আগে ঢাকা থেকে ফেনী যেতে সময় লাগত তিন থেকে সর্বোচ্চ চার ঘণ্টা। সেখানে এখন লাগছে ছয় থেকে আট ঘণ্টা। ছয় ঘণ্টার আগে ফেনী পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে গত কয়েক দিন ধরে। যাত্রীদের অভিযোগ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অনেক জায়গা এখনও খানাখন্দে ভরা। এ রুটে বাসের শিডিউলও ঠিক নেই।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মালেক জানান, মহাসড়কে যানজটের কারণে গাড়ি চলতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে নির্দিষ্ট সময়ে বাস পৌঁছতে ও ফিরে আসতে পারছে না। এতে যাত্রীদের কিছুটা অসুবিধা হলেও বড় ধরনের কোনো সমস্যা নেই।
এদিকে গতকাল সকালে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনের মহানগর প্রভাতী ট্রেনে প্রায় সব বগির বেশিরভাগ ফ্যানই নষ্ট। টয়লেট খুবই অপরিচ্ছন্ন। মহানগর প্রভাতী চট্টগ্রামের উদ্দেশে ৭টা ৪০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও ছেড়েছে অনেক পরে। অন্যদিকে রাজশাহীগামী সিল্ক সিটি গতকাল ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল বিকেল পৌঁনে ৩টায়। কিন্তু ছেড়েছে সন্ধ্য্যা ৬টারও পরে। গত তিন দিন ধরে একের পর এক শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে ট্রেনে। গতকালও দেখা গেছে, ট্রেনের ছাদ থেকে শুরু করে ইঞ্জিন, ক্যান্টিন, কামরার জোড়া, বাম্পারসহ সবখানেই মানুষ।
দাউদকান্দিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট : দাউদকান্দিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতকাল ভোরে একটি কাভার্ডভ্যান ও একটি লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন নিহত হয়। এ দুর্ঘটনার পর মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। হাইওয়ে পুলিশ সূত্রের বরাত দিয়ে কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, ভোর ৫টায় মহাসড়কের জিংলাতলী এলাকায় ঢাকাগামী একটি লরির সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি কাভার্ডভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে কাভার্ডভ্যানের চালক কাজী লিটন নিহত হয়। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দুটি রাস্তার ওপর পড়ে থাকলে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। উদ্ধার তত্পরতা শেষে সকাল ১০টার দিকে পুনরায় যানবাহন চলাচল শুরু হলেও দুপুর ২টা পর্যন্ত মহাসড়কে যানজট লেগেই ছিল। এরই মধ্যে গতকাল জিংলাতলীতে কাভার্ডভ্যান ও লরির মুখোমুখি সংঘর্ষের পর নতুন করে আবারও মহাসড়কে যানজট বেড়ে যায়।
ঢাকা বাইপাস ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট : রূপগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, গতকাল দুপুরের পর থেকেই গোলাকান্দাইল চৌরাস্তায় যানজট শুরু হয়। গাজীপুর-চট্টগ্রাম সড়কে ঢাকা বাইপাসের কাঞ্চন, গোলাকান্দাইল, বস্তল, মদনপুর, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের তারাব, বিশ্বরোড, বরাব, রূপসী, বরপা, ভুলতা, আধুরিয়া এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। যাত্রীরা জানান, যাত্রীবাহী বাসে চড়ে ঢাকা থেকে রূপগঞ্জের ভুলতায় পৌঁছতে সময় লাগে ৩০ মিনিট। অথচ এখানকার যানজট এলাকা পেরুতে সময় লাগছে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। সরেজমিনে দেখা যায়, গতকাল দুপুরের পর থেকে ঢাকা বাইপাস সড়কে আট কিলোমিটার ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ১০ কিলোমিটার জুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়।
মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটে ভাড়ার নৈরাজ্য : ভ্রাম্যমাণ আদালত, পুলিশসহ প্রশাসনের কঠোরতায় শিবচরের কাওড়াকান্দি ঘাট ব্যবস্থাপনায় উন্নতি হলেও ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য ও চাঁদাবাজির ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিবচর সংবাদদাতা জানান, গত দু’দিন ধরে মাওয়া-কাওড়াকান্দি হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় যাত্রীদের ঢল নেমেছে। এ সুযোগে শিবচরের কাওড়াকান্দি ঘাট এলাকা থেকে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার সব যানবাহনে দ্বিগুণ থেকে আড়াইগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।
ডুবোচর আতঙ্কে যাত্রীরা : মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মাওয়া-কাওড়াকান্দি ও মাওয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে ডুবোচর আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত মঙ্গলবার মাওয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে যানবাহন ও যাত্রী নিয়ে রো রো ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন পদ্মা নদীর মাঝখানে ডুবোচরে আট ঘণ্টা আটকে থাকে। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের।
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট পরিদর্শনে নৌপরিবহন মন্ত্রী : রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া ঘাট পরিদর্শন করেন। পরে মন্ত্রী দুই ঘাটের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, ঈদে মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে এবার দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে সর্বাধিকসংখ্যক ফেরি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উভয় ঘাটের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করায় মানুষের কোনো দুর্ভোগ হচ্ছে না।
ঢাকা-টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কেও যানজট : ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ধেরুয়া থেকে দেওহাটা পর্যন্ত গতকাল দুপুর ২টার দিকে প্রায় আট কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে সকালে এলেঙ্গায় থেমে থেমে যানজটের সৃষ্টি হলেও গত বছরের তুলনায় তা অনেকটাই কম বলে জানান টাঙ্গাইল প্রতিনিধি।
প্রভাবশালী ও জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত : সমাজের প্রভাবশালী ও জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ফেনী সংবাদদাতা জানান, গতকাল সকালে ফেনী সদর এলাকার শর্শদিতে এক যাকাত প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেন। মহাসড়কে তেমন যানজট হচ্ছে না দাবি করে মন্ত্রী আরও বলেন, যেটুকু যানজট হচ্ছে তা একাধিক কারণেই হচ্ছে।