বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্তক ঘটনা স্মরণ করে পাশে বড় বোন শেখ হাসিনাকে রেখে নিজের অতৃপ্ত আর অসমাপ্ত জীবনের কথা শোনালেন শেখ রেহানা।

তিনি বললেন,  “আমাদের ধর্মে প্রিয়জন মারা গেলে দোয়া-কালাম পড়ানো হয়। প্রিয়জনকে মুখ দেখানো হয়। কিন্তু, আমরা দুই বোন তাও পারিনি। এজন্য আমাদের জীবন অতৃপ্ত ও অসমাপ্ত হয়ে থাকবে।” “এখনো মনে হয়, আপার মাথায় হাত রেখে আব্বা বলছেন- এটা কর,” “তবুও জীবন চলে যাচ্ছে, চলে যাবে,” চোখের জল চেপে ধরেই বলেন তিনি।

সোমবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই অনুষ্ঠানে প্রথম আওয়ামী লীগ আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে দেখা গেল শেখ রেহানাকে। বাবার বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে কেঁদে ফেলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।

শেখ রেহানা বক্তব্য শেষ করার পর শেখ হাসিনা তার আসন থেকে উঠে গিয়ে ছোট বোনকে জড়িয়ে ধরেন, কাঁদতে থাকেন দুজনই।

এরপর বড় বোন শেখ হাসিনা বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “আমার আর কিছু বলার নেই। যা বলার তা রেহানাই চমৎকার করে বলে দিয়েছে।”

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মুস্তফা নূরউল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, সাংবাদিক বেবী মওদুদ, গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদক অধ্যাপক ফকরুল আলম এবং প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের মালিক মহিউদ্দিন আহমেদ। গ্রন্থটি থেকে কিছু অংশ পড়ে শোনান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।

শেখ রেহানা তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, “এই বইয়ের ভেতর কী আছে, তা নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি। তা করবেন অন্যজন। আমি তো আমার বাবার কথা বলব।”

’৭৫-এর ১৫ অগাস্ট পরবর্তী সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কাঁপা-কাঁপা গলায় বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে বলেন, “তখন আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দেশে ফিরতে পারব কিনা? ৩২ নম্বরের বাড়ির কী অবস্থা, টুঙ্গীপাড়ার বাড়ির কী অবস্থা? কিছুই জানতাম না। তারপরও আত্মবিশ্বাস ছিল।”

“আমরা তখন নিজেরাই নিজেদের সামলাতাম। দুই বোন দুই বোনকে ধরে কাঁদতাম। দুই জন দুই জনকে সান্ত্বনা দিতাম। কখনো নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিতাম,” বলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রবাসে থাকা শেখ রেহানা।

বাবার জীবনী তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “বুঝতে পারিনি- এটা কী অমূল্য সম্পদ। গ্রন্থের পাতায় পাতায় রয়েছে- আব্বার জীবনের সাক্ষী।

“আব্বা কষ্ট করেছেন। কিন্তু, তিনি তার বিশ্বাসে অটল ছিলেন। এজন্যই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।”

এই গ্রন্থ সম্পাদনার ক্ষেত্রেও কোনো সত্য গোপন করা হয়নি জানিয়ে শেখ রেহানা বলেন, “বইয়ের এক জায়গায় আছে- তিনজন এক টিকিটে দিল্লি থেকে ফিরেছেন। চিন্তা করলাম- আব্বা টিকিট ছাড়া? তারপর, হিসাব করে দেখলাম- বয়স কত ছিল। ওই বয়সে ওটা সাজে।”

সবাইকে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ার আহবান জানিয়ে শেখ রেহানা বলেন, “আপনারা বইটি পড়বেন। অন্যকে পড়তে সাহায্য করবেন। সাহস জোগাবে।”

আবেগজড়িত কণ্ঠেই শেখ হাসিনা বলেন, “আসলে বইগুলো … । আসলে আমাদের কথা- তিনি তো জনগণের নেতা। তার বই আমরা বাংলার জনগণের হাতে তুলে দিতে পেরেছি।”

বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে বলেন, “রেহানা আমার পাশে না থাকলে অনেক কাজ কঠিন হয়ে যেত। বেবীও এখানে আছে। সব কাজই ও করেছে। আমি তো কম সময় পেয়েছি। বেবী নিজেই অনেক কাজ করেছে।”

বাবার লেখার পেছনে মায়ের অনুপ্রেরণার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা ধরা গলায় বলেন, “বইটি বের হল। কিন্তু, মা-ই দেখে যেতে পারল না।”

কারাগারে থাকাকালে স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা রেনুর আগ্রহেই আত্মজীবনী লেখার শুরু বলে বঙ্গবন্ধু লিখে গেছেন। তবে ১৯৫৫ সালের পরের ঘটনা আর লিখে যেতে পারেননি তিনি।

এই গ্রন্থ প্রকাশে যুক্ত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আগামীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, চীন সফর এবং স্মৃতির পাতা থেকে- এই তিনটি বই প্রকাশ করা হবে। ‘স্মৃতির পাতা থেকে’ এই নামটি বঙ্গবন্ধুর দিয়ে গিয়েছিলেন।

সবাইকে এই গ্রন্থটি পড়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এটা পড়লে জানতে পারবেন- দেশ, জাতি ও স্বাধীনতার জন্য একজন কত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে।”

ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন অধ্যাপক মুস্তফা নূরউল ইসলাম। তিনি বলেন, “এত ঘটনাবহুল রাজনীতি অনেক কম রাজনীতিবিদেরই আছে। বঙ্গবন্ধু নাজেল হন নাই। তিনি মাটি থেকে উঠে এসেছেন।”

কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শাসমুল হক বঙ্গবন্ধুর এই আত্মজীবনীকে বাংলাদেশের ইতিহাস আখ্যায়িত করে বলেন, “বঙ্গবন্ধুর মতো নেতৃত্বগুণ, নীতি এবং সাহসী নেতৃত্ব আমাদের দরকার। এই বইয়ের পাতায় পাতায় মণিখণ্ড ছড়িয়ে আছে। এটি বিশ্বের ইতিহাসে একটি অমূল্য দলিল।”

বেবী মওদুদ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “কোথা থেকে শুরু করব, জানি না। তবে, জানতাম, এই দিনটি আসতেই হবে।
“এই গ্রন্থটি সময়ের দর্পণ। এই গ্রন্থটি শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পাবে বলে আমার ধারণা।” তিনি আরো বলেন, “আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি। তার দুই মেয়ে আছে। এবার এই বইটি পেয়েছি।”

অনুষ্ঠানের শুরুতে শেখ হাসিনা উপস্থিত হওয়ার পর উপস্থিত আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের স্লোগান দিতে থাকলে কিছুটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

তখন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, “বঙ্গবন্ধুর লাশ তিনদিন ওই বাড়িতে পড়েছিল। তখন তো কেউ আসেনি। একজনকে তো হারিয়েছি। আরেকজন আমাদের সাথে আছে। তাকে নিয়েই আমরা চলছি। এভাবে বিশৃঙ্খল হলে তো যুদ্ধে জেতা যাবে না।”

প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “বইটি কিনবেন। বইটি পড়বেন। নয়েজ দিয়ে লাভ নেই। মেধা দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। স্লোগান দিয়ে বেশি কিছু করা যায় না।”

মহিউদ্দিন আহমেদ ভারতের পেঙ্গুইন এবং পাকিস্তানের অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত দুটি বই শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন।

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।