কেটে যাচ্ছে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে দেখা যাচ্ছে আলোর আভা। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর অর্থায়নে ফিরে আসছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির সঙ্গে এখন চলছে সরকারের চূড়ান্ত দরকষাকষি। আর এই আলোচনাকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিতে ঋণচুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে অন্য দুই দাতা সংস্থা এডিবি ও জাইকা। ফলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় বাড়তি এক মাস সময় পেল সরকার। সমঝোতা হয়ে গেলে সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে বাতিল চুক্তিটি পুনর্বহাল করা হবে। অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক বা অন্য তিন দাতা সংস্থার সঙ্গে নতুন কোনো চুক্তির প্রয়োজন হবে না। 

বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার আভাস দিয়েছেন ঢাকা সফরে আসা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক হুয়ান মিরান্ডা। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের জোরের সঙ্গে বলেন, পদ্মা সেতু হবে। আর এই সেতুতে থাকবে এডিবি। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যৌথভাবে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে সরকারের সঙ্গে ইতোমধ্যে চুক্তি করেছে এডিবি, জাইকা ও আইডিবি। 

মিরান্ডার সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, পদ্মা সেতু হবেই হবে। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করায় সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারক বিকল্প অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের কথা বলে এলেও অর্থমন্ত্রী শুরু থেকেই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণের পক্ষে। তাই পদ্মা সেতু হবে বলতে তিনি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ সেতু হবে বুঝিয়েছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। 

এর একদিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ হবে মর্মে আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে ভারত ও জাপানের সঙ্গে কাজ করছে তার দেশ। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। দেশটির পছন্দে সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাই বিশ্বব্যাংকের কাছে দেশটির চাওয়া না চাওয়ার মূল্য অনেক। অন্যদিকে সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশই ভারতীয়। আর জাপানের উন্নয়ন এজেন্সি জাইকা ও এডিবি বিশ্বব্যাংকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তাই বিশ্বব্যাংকের ওপর তাদেরও কিছুটা প্রভাব রয়েছে। 

২৯০ কোটি ডলারে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। বাকি অর্থের বেশিরভাগ দেওয়ার কথা অন্য তিন দাতা সংস্থা এডিবি, আইডিবি ও জাইকার। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সেতুর পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ঋণ পেতে সরকারকে কয়েকটি শর্ত দেয় সংস্থাটি। কিন্তু সরকার তা পালন না করায় গত জুনে অর্থায়ন বাতিল করে তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীসহ একাধিক নীতিনির্ধারক মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ, নিজস্ব অর্থায়নসহ নানা বিকল্প অর্থায়নে সেতু নির্মাণের কথা বলে এলেও ভেতরে ভেতরে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টাও চলতে থাকে। এর অংশ হিসেবে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন, ছুটিতে যান সেতু বিভাগের সচিব মোশারফ হোসেন। শুধু অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগ সংক্রান্ত শর্তটি এখনও পরিপালন হয়নি। আর একে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। এদিকে গত সোমবার মালয়েশিয়ার বিশেষ দূত যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে তার দেশের চূড়ান্ত প্রস্তাব জমা দেন। 

চলছে নানামুখী চেষ্টা : পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে চলছে চেষ্টা। সরকার নিজে সংস্থাটির সঙ্গে যোগাযোগ করার পাশাপাশি সংস্থার ঢাকা অফিস, দক্ষিণ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্টসহ অনেককে কাজে লাগানো হচ্ছে। জানা গেছে, গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ওয়াশিংটন সফর করেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সংস্থায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ তারেকের সঙ্গে বৈঠক করেন। 

পুনর্বিবেচনার চিঠি যায়নি : ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য এখনও কোনো চিঠি পাঠানো হয়নি বিশ্বব্যাংকে। তবে চিঠির চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হয়ে রয়েছে। সংস্থাটির কাছ থেকে কার্যকর সবুজ সঙ্কেত পেলেই এই চিঠি পাঠানো হবে। 

চুক্তির সময় বাড়াল এডিবি ও জাইকা : পদ্মা সেতুর অর্থায়নে সরকারের সঙ্গে করা ঋণচুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। আজ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে এবং প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকে ফিরে আসার সম্ভাবনার মুখে এই সময় বাড়ানো হয়েছে। গতকাল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এডিবির কর্মকর্তারা সময় বাড়ানোর প্রস্তাবে সায় দেন। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি ছাড় করা হবে আজ। উল্লেখ্য, প্রকল্পে এডিবির ৬১ কোটি ৫০ লাখ ও জাইকার ৪০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা। এছাড়া ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) দেওয়ার কথা ১৪ কোটি ডলার।

নতুন চুক্তির প্রয়োজন নেই : পদ্মা সেতুর অর্থায়নে আলোচিত চার দাতা সংস্থার সঙ্গে নতুন চুক্তির প্রয়োজন হবে না। পুরনো চুক্তির আলোকেই কার্যক্রম চলবে। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আগের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করলে বাতিল করা চুক্তিটি পুনর্বাহল করবে। অন্যদিকে এডিবি ও জাইকা চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে। আর আইডিবির চুক্তি শুধু বহাল নয়, ইতোমধ্যে সংস্থাটি চুক্তির অর্থ ছাড় করেছে। 

মিরান্ডার আশাবাদ : বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার ব্যাপারে চূড়ান্ত সমঝোতা না হলেও পদ্মা সেতুর বিষয়ে দৃঢ় আশাবাদ প্রকাশ করেছেন প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক হুয়ান মিরান্ডা। গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতু হবে। একই কথা দু’বার উচ্চারণ করেন হুয়ান মিরান্ডা। দু’দিনের সফরে গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা এসেছেন তিনি। 

পদ্মা সেতু প্রকল্পে এডিবি থাকছে কি না জানতে চাইলে মিরান্ডা বলেন, ‘এডিবি আছে, থাকবে। এই প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার এডিবি।’

মুহিতের প্রত্যয় : এডিবি কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের পর পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রত্যয় নিয়ে কথা বললেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গতকাল সচিবালয়ে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীকে বেশ নির্ভার দেখা যায়। উত্ফুল্ল অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এডিবির মহাপরিচালক যা বলেছেন, তাই আমার কথা। পদ্মা সেতু হবেই হবে।’

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আজ সকালে এডিবির সুখবর তো আপনারা পেয়েছেন। কাল জাইকারটাও পেয়ে যাবেন।’ পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংককে ফেরাতে আলোচনা চলছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমরা একটা ‘ডেলিগেট নেগোসিয়েশন’ করছি। এ রকম অবস্থায় আমি কথা বলতে চাচ্ছি না।”