কানাডায় এক বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ২ কোটি ডলার আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, মঞ্জুর মোর্শেদ খান নামের ওই ব্যক্তি ১ হাজারেরও বেশি কন্ডোমিনিয়ামের মালিককে ঠকিয়ে পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে।
তিনি ওই সব ফ্ল্যাট মালিকদের না জানিয়ে তাদের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ তুলেছেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর কানাডার অনলাইন দ্য স্টার পত্রিকায় এ বিষয়ে দীর্ঘ একটি রিপোর্ট বেরিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মঞ্জুর মোর্শেদ কানাডার টরোন্টোতে চ্যানেল প্রপার্টিজ ম্যানেজমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। তিনি ৫টি ভবনের ১ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির নামে ওই বিশাল অঙ্কের অর্থ তুলে নিয়েছেন। ওই রিপোর্টে মঞ্জুর মোর্শেদ সম্পর্কে বলা হয়েছে- তিনি জুতো কেনার মতো ঘন ঘন গাড়ি কেনেন। প্রতি আঙুলে পরেন স্বর্ণ আর হীরার আংটি। তার সাবেক কর্মচারীরা বলেছেন, তিনি সপ্তা কয়েক আগেই বাংলাদেশের উদ্দেশে কানাডা ছেড়েছেন। কানাডায় আর্থিক বাণিজ্যিক একটি প্রতিষ্ঠান লোকজনকে অর্থ ধার দেয়। তারা বলেছেন, মঞ্জুরের প্রতারণার তারাও শিকার হয়েছেন। কানাডার ইকুইট্যাবল ট্রাস্ট কোম্পানি নামের একটি সংস্থার প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু মুর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটি একটি অভিজাত ও অভিনব কায়দার প্রতারণা। গত বুধবার চ্যানেল প্রপার্টিজ ম্যানেজমেন্ট নামের প্রতিষ্ঠানটিকে টরোন্টোর উডব্রিজ এলাকায় অত্যাধুনিক অফিস ভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এর কারণ, ওই ভবনের ভাড়া পরিশোধ করা হয়নি।
কানাডার আবাসন শিল্পের সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন প্রতারণা তারা জীবদ্দশায় দেখেননি। ওন্টারিওর অ্যাসোসিয়েশন অব কন্ডোমিনিয়াম ম্যানেজার্সের প্রেসিডেন্ট ডিন ম্যাকাবি বলেন, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা। এ ঘটনায় প্রতিটি মানুষই বিস্মিত ও আতঙ্কগ্রস্ত। স্টার পত্রিকা জানতে পেরেছে, মঞ্জুর মোর্শেদ খানের কোম্পানিটি কমপক্ষে ৪টি কন্ডোমিনিয়াম (অ্যাপার্টমেন্ট) করপোরেশন পরিচালনা করতো। এর সবগুলোর ক্রেতাই প্রতারণার শিকার। তাদের একজন মঞ্জুর মোর্শেদ, তার কোম্পানি ও ইকুইট্যাবল ট্রাস্টসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩১ লাখ ডলারের একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করেছেন।
দ্যা স্টার আরও জানায়, ওই মামলাটি করেছেন ২৫ গ্রিনভিল স্ট্রিটের একটি বিলাসবহুল কন্ডোর মালিক। টরোন্টোর ডাউন টাউনে এ ঠিকানায় কন্ডোমিনিয়ামের ২০০টি ইউনিট রয়েছে। এর মালিকরা অভিযোগ করেছেন, তাদেরকে পাশ কাটিয়ে মঞ্জুর মোর্শেদ প্রতারণার মাধ্যমে ওই কন্ডোমিনিয়ামের অ্যাপার্টমেন্টগুলো রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি ৩০ লাখ ডলার হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া অন্য তিনটি প্রোপার্টিজের পরিচালনা পর্ষদ কন্ডোমিনিয়ামের মালিকদের অবহিত করেছেন যে, সেখানেও প্রতারণা করা হয়েছে। অন্য একটি কন্ডোমিনিয়ামের অর্থ জালিয়াতির মাধ্যমে সরিয়ে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে মঞ্জুর মোর্শেদের বিরুদ্ধে। আলবিয়ন রোডের ২৩৬ নং বাড়ির মালিকরা আরেকটি পৃথক মামলা করেছেন। এতে অভিযোগ করা হয়েছে, মঞ্জুর মোর্শেদ খান টেন্ডার প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি করে সবচেয়ে কমদরের নামে এসব অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির কাজ পান। তারপর সেসব কাজ অর্ধেক দরে অন্যদের সাব কন্ট্রাক দেয়া হয়। অভিযুক্ত চ্যানেল প্রপার্টিজ ও মঞ্জুর মোরশেদ খানের পক্ষ থেকে অবশ্য এরই মধ্যে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে একটি বিবৃতি জমা দেয়া হয়েছে। এতে দাবি করা হয়েছে, এসব অভিযোগের কোনটিই সত্য নয়।
গত সপ্তায় ২৫ গ্রিনভিলের ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত একদল বাসিন্দা আইনজীবীদের সাথে বৈঠক করতে জড়ো হয়েছিলেন। তাদেরই একজন বলেন, আমার কাছে যে প্রশ্নটি বারবার ঘুরে ফিরে আসছে তাহলো এমনটা কীভাবে ঘটতে পারে? ওই পত্রিকায় আরও বলা হয়, পুরো প্রক্রিয়ায় মঞ্জুর মোর্শেদ একগাদা বানোয়াট আইনি কাগজপত্র জোগাড় করেছিলেন ঋণ পাওয়ার জন্য। এর মধ্যে একটি নথিতে এমনটাও বলা হয় যে, তার কোম্পানির দু জন কর্মী কন্ডোমিনিয়াম বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি। আদালতে দায়ের করা অভিযোগ মতে, মঞ্জুর মোর্শেদ কন্ডোমিনিয়ামের নামে ঋণ জোগাড় করেন এবং তার দু কর্মী বোর্ড পরিচালক হিসেবে ওই ঋণ উঠান। বোর্ডের অজ্ঞাতেই তিনি কন্ডোমিনিয়ামের নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন এবং গত জানুয়ারিতে ওই অ্যাকাউন্টে ৩১ লাখ ডলার জমা দেয়া হয়। এর ৮ মাস পর মর্টগেজ দানকারী প্রতিষ্ঠান ইকুইট্যাবল ট্রাস্ট কোম্পানি, যেটি এরই মধ্যে কন্ডো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত, তার পক্ষ থেকে ২৫ গ্রিনভিল স্ট্রিটের বিরুদ্ধে অর্থ জমা না দেয়ার একটি নোটিস দেয়া হয়। এভাবে ইকুইট্যাবল ট্রাস্ট সব মিলে ১৪০ লাখ ডলার অর্থ জমা না দেয়ার নোটিস জারি করে বিভিন্ন শেয়ার হোল্ডারকে। আর এসব অর্থই চ্যানেল প্রপার্টিজের মাধ্যমে পরিশোধ হওয়ার কথা ছিলো।
ইকুইট্যাবল ট্রাস্টের প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু মুর আরও জানান, তার সংস্থার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে দ্যা স্টার আরও জানায়, মামলার অভিযোগে চ্যানেল প্রপার্টিজের যে দু কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের একজন মোহাম্মদ ইরফান নাইম (৩৮)। তিনি দাবি করেন, পুরো কাজটিই তার অজ্ঞাতে হয়েছে এবং এখানে তার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। নাঈম বলেন, আমার জীবন এখন বিধ্বস্ত। চ্যানেল প্রপার্টিজে তিনি যোগ দেন প্রায় ৪ বছর আগে। এর আগে ২৫ গ্রিনভিল স্ট্রিটে তিনি সিকিউরিটি সুপারভাইজার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরে মঞ্জুর মোর্শেদ পুরো প্রপার্টি কিনে নেয়ার পর তাকে এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেন। তিনি বলেন, এটি লুফে নেয়ার মতো একটি অফার ছিলো এবং তারপর ৪ বছর সবকিছু ভালোভাবেই চলছিলো, বিশেষ করে মধ্য আগস্টে একটি ফোন কল পাওয়ার আগ পর্যন্ত।
নাইম জানান, একজন গ্রাহকের আইনজীবী ফোন করে সুপারভাইজার মিহাইলা জারকোভিচের সাথে কথা বলতে চান। এরপর জারকোভিচ তাকে ফোন করেন। তিনি তখন কাঁপছিলেন ও কাঁদছিলেন। বারবার বলছিলেন, আমরা শেষ হয়ে গেছি। তিনি তখনই নাইমকে জানান যে, ওই আইনজীবী ৩০ লাখ ডলার ঋণ নেয়ার একটি ডকুমেন্ট তাকে ফ্যাক্স করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, জারকোভিচ ও আমার নামেই ওই ঋণ তোলা হয়েছে। একথা শুনে আমি নির্বাক হয়ে যাই। জারকোভিচ আমাকে ডকুমেন্টটি ফ্যাক্স করলে আমার মনে হয় জীবনে অমানিশা নেমে এসেছে। এরপর আমরা বারবার মঞ্জুর মোর্শেদ খানকে ফোন করার চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি আর আমাদের ফোন ধরছিলেন না বা ইমেলেরও জবাব দিচ্ছিলেন না। আমরা আগে শুনেছিলাম মঞ্জুরের বস দুবাই থাকেন। পরপরই নাইম বোর্ড প্রেসিডেন্টের কাছে ডকুমেন্টটি পাঠিয়ে দেন। এ এলাকায় ও প্রকল্পে আমি ৮ বছর ধরে কাজ করছি। এখানকার বাসিন্দা ও বোর্ড আমার সততা ও নিষ্ঠার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। জারকোভিচ অবশ্য এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের সাথে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
নাইম এখন পুরোপুরি বেকার। বোর্ড চ্যানেল প্রপার্টিজকে ১৮ আগস্ট তার তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। ২৩৬ অ্যালবিয়ন সড়কে মঞ্জুর মোর্শেদ খানের প্রতিষ্ঠান কয়েকটি ভবনের বাহির দেয়াল, জানালা ও ব্যালকনি নির্মাণের কাজ পেয়েছিলো। এ সময় টেন্ডার জালিয়াতি করতে নিজেই কানালি ইঞ্জিনিয়ারিং নামে ও আরেকটি কোম্পানির নামে টেন্ডার জমা দেন মঞ্জুর মোর্শেদ। এর দেয়া ১২ লাখ ডলারের দরটিই ছিলো সর্বনিম্ন এবং সেটিকেই কাজ দেয়া হয়। কিন্তু কাজ পাওয়ার পর কানালির পক্ষ থেকে বলা হয়, কাজ শেষ করতে তাদের আরও বেশি অর্থ প্রয়োজন হবে এবং শেষ পর্যন্ত এ কাজে ১৩ লাখ ডলার দাবি করা হয় বলেই আদালতের নথিতে উল্লেখ রয়েছে। টাকা পেলেও কাজ করেনি কানালি ইঞ্জিনিয়ার্স। বরং দরকৃত অর্থের অর্ধেক খরচ করে সেসব কাজ সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়ে দেয়।
২০০৩ সালে মঞ্জুর মোর্শেদ খান তার নিজস্ব কোম্পানি গড়ে তোলার আগে মার্টিন গ্রোভ ও রেক্সডেলের কাছে একটি ভাড়া ভবনের সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর তার ব্যবসা গড়ে তোলার পর ৪০টি কন্ডো বিক্রি করেন এবং সব সময়ই কম বেশি ১৫ জন কর্মচারী তার সাথে কাজ করতেন।
কে এই মঞ্জুর মোর্শেদ খান? এ প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন রকমের। চ্যানেল প্রপার্টি ম্যানেজমেন্টে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে ৪ বছর কাজ করতেন রঞ্জন ভাসিন। তার মতে, মঞ্জুর খুব ধার্মিক ও স্টাফদের খুশি রাখতেন। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনেরও খোঁজখবর করতেন। তাকে আমাদের কাছে কখনই খারাপ একটি মানুষ মনে হয়নি। আরেক সাবেক কর্মচারী বলেন, মঞ্জুরকে খুবই দয়াশীল ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হতো। তিনি একজন ভালো ব্যবসায়ী ছিলেন। প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে দুবাই যেতেন সেখানকার ব্যবসা দেখাশোনা করতে। কতোগুলো বিষয়ে সকলেই একমত ছিলেন, মঞ্জুর দামি গাড়ি পছন্দ করতেন, জুতোর মতো যখন যেমন পছন্দ গাড়ি কিনতেন।
একটি সংবাদমাধ্যম লিখেছে, সপ্তা খানেক আগে ব্রামটনে তার দু তলা বাড়িটিতে গিয়ে বিলাসবহুল সব গাড়ি দেখা যায়। যার তালিকায় রয়েছে মার্সিডিজ, লেক্সাস, অডি, বিএমডব্লিউ। দুটি বিশাল গ্যারেজ ভর্তি হয়ে আছে গাড়িতে। বাড়িটিতে ৪টি ভিডিও ক্যামেরা বসানো পর্যবেক্ষণের জন্য। কলিংবেল টিপে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি, এমনটাই জানায় সংবাদমাধ্যমটি।
এতে আরও বলা হয়, মঞ্জুর মোর্শেদ খানের মেয়ে শারমিন সাদিয়ার (২৫) সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। পরিবারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয় তারা এ নিয়ে মন্তব্য করতে চান না। তবে এরই মধ্যে কোম্পানির সব কর্মীকে চাকরিচ্যুত করেছেন সাদিয়া। তিনি কর্মীদের জানান, তার পিতা দেশে ফিরে গেছেন এবং তার মা খুব অসুস্থ। সেদিন তিনি আরও বলেন, আমাদের আর কোনো সম্পত্তি নেই যা দেখাশোনা করতে হবে। তাই এখানে কোনো কাজ নেই আপনারা সবাই চলে যান।