কুয়ালালামপুরের বিভিন্ন এলাকায় গত ৩ দিনে যত বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁদের সবাই প্রবাসী বাংলাদেশিদের একই সমস্যার কথা বলেছেন।
কারণ, ১১ মাস ধরে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশিদের ভিসা নবায়ন না করে ঝুলিয়ে রেখেছে। ফলে অবৈধ হয়ে পুলিশের গ্রেপ্তার-আতঙ্ক নিয়ে তাঁদের দিন কাটছে। প্রবাসী কর্মীরা জানালেন, বিশেষজ্ঞ ও পেশাদার ছাড়া মালয়েশিয়ার সব সাধারণ শ্রমিককে ১ বছরের জন্য ভিসা দেয় মালয়েশিয়ার অভিবাসন অধিদপ্তর। প্রতিবছর এই ভিসা নবায়ন করতে হয়। এর আগে কখনো সমস্যা না হলেও ২০১০ সালে এসে বাংলাদেশিদের ভিসা নবায়ন করছে না মালয়েশিয়া। বিশেষ করে, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে কলিং ভিসায় যে ৪ লাখ বাংলাদেশি এসেছেন, তাঁদের নতুন করে ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। এঁদের অনেকেই বিদেশে আসতে যে খরচ হয়েছে, সেই টাকাই তুলতে পারেননি। এ ছাড়া ১৩ বছরের বেশি সময় যাঁরা আছেন-এমন বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। তাঁদের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ। মালয়েশিয়ায় অবৈধ বাংলাদেশির সংখ্যা কত: সেই তথ্য নিয়েও আছে বিভ্রান্তি। বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী বেশ কিছুদিন ধরে বলছেন, মালয়েশিয়ায় মোট অবৈধ লোকের সংখ্যা ৩ লাখ। তবে প্রবাসীদের বক্তব্য, এই সংখ্যা ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ। প্রবাসীদের অভিযোগ, অবৈধ প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না। তবে দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ এই শ্রমিকদের বৈধ করতে সব ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। খুব শিগগির সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রবাসীদের পাল্টা অভিযোগ, ১১ মাস ধরে দূতাবাস একই কথা বলছে। মুন্সিগঞ্জের মাসুদ রানা কাজ করছিলেন কোতারিয়া এলাকার ১টি ইলেকট্রনিকসের দোকানে। সেখানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানালেন, ১৪ বছর আছেন মালয়েশিয়ায়। কিন্তু এ বছর ভিসা পাচ্ছেন না। মাসুদ বলেন, ‘রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে পারি না। পুলিশ ধরে প্রথমে পরিচয়পত্র চায়। এরপর পাসপোর্ট। দেখাতে না পারলে ঘুষ চায়। দিতে না পারলে বলে, থানায় চল।’ শরীয়তপুরে বাড়ি কাজী জামানের। ২০ বছর ধরে আছেন মালয়েশিয়ায়। মা-বাবা-স্ত্রী আর ৪ বছরের মেয়ে জুবাইদা আছে বাড়িতে। হতাশ কণ্ঠে বললেন, ‘কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশিরা কাজ না পেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে। এখন সবাই কাজ পেয়েছে। কিন্তু ভিসার মেয়াদ নেই। আমার ২০ বছরের জীবনে এমন বিপদে পড়িনি। নিজের ভিসা তো নেই-ই, দেশ থেকে ২০০ লোক এনেছিলাম। ওরাও একই বিপদে। বাড়িতে কিছু বলতে পারি না। ছোট্ট মেয়েটার কথা খুব মনে পড়ে।’ কুমিল্লায় বাড়ি মোহাম্মদ শামীমের। কুয়ালালামপুরের একটি মুদির দোকানে কাজ করছিলেন। জানালেন, এ বছরের ৯ জুন ভিসা নবায়নের জন্য আবেদন করেছেন। এখনো পাননি। নারায়ণগঞ্জে বাড়ি মোহাম্মদ ওহিদের। তাঁর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে ছয় মাস আগে। জানালেন, ‘পুলিশ দেখলেই ভয় লাগে। হয় টাকা নেবে, নইলে জেলে নেবে।’ চুয়াডাঙ্গার জাহাঙ্গীর কুয়ালালামপুরে নির্মাণশ্রমিকের কাজ করেন। জানালেন, ২ লাখ টাকা খরচ করে এসেছেন। এখনো চালানের টাকাই তুলতে পারেননি। এপ্রিল মাসে ভিসার আবেদন করেছেন। এখনো পাননি। পেরাক রাজ্যের ইপো এলাকায় ব্যবসা করেন মোহাম্মদ মুসা। বাংলাদেশি মহলে বেশ পরিচিত। দুপুরে খেতে এসেছিলেন এক বাংলাদেশির দোকানে। সেখানেই দেখা। বললেন, ‘বাংলাদেশি জিনিসপত্র বিক্রি করে এখানে চলি। কিন্তু অবৈধ হওয়ার কারণে বাংলাদেশিরা এখন বের হয় না। বেচাকেনা নেই। এ মাসে বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে টাকা এনে ধার শোধ করছি।’ একই রকম কথা প্রায় সবার। বাংলাদেশিরা জানান, পুলিশের ভয়ে বাড়ি থেকে লাফ দিয়ে অনেকের হাত-পা ভেঙে যায়। রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না। মালয়েশিয়ার রেলার (অভিবাসন পুলিশ) রাতে বিভিন্ন এলাকায় হানা দেয়। যাঁকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। পয়সা দিয়ে তাঁদের ছাড়িয়ে নিতে হয়। নইলে জেল। নারায়ণগঞ্জে বাড়ি আবদুল মতিনের। জানালেন, পুলিশ অনেক সময় রাস্তাঘাটে তাঁদের কাছ থেকে জোর করে টাকা নিয়ে যায়। ভয়ে কিছু বলতেও পারেন না। ইপো এলাকার আরেক ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। তিনি মুঠোফোনে জানালেন, তাঁর দোকানে ৮ জন বাংলাদেশি কাজ করেন। শুক্রবার পুলিশ এসে ৩ জনকে ধরে নিয়ে গেছে। এখন ১০ হাজার টাকা ঘুষ চায়। প্রবাসী এই বাংলাদেশিদের কথা শেষ হতেই চায় না। সবাই বলতে চান তাঁদের কষ্টের কথা। তাঁদের বক্তব্য, দেশে মা-বাবা ও পরিবার-পরিজনকে এসব বলতে পারি না। বললে তাঁরা দুশ্চিন্তা করবেন। আপনারা শোনেন। প্রধানমন্ত্রীকে জানান। ফরিদপুরের নয়ন হালদার, মাদারীপুরের রেজা হোসেন, টাঙ্গাইলের সানাউল্লাহসহ আরও অনেকেই ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘মালয়েশিয়া কোনো বাংলাদেশির ভিসা নবায়ন করছে না। দূতাবাস কিংবা সরকার কেউ আমাদের পাশে নেই। থাকলে আজকে এত বড় বিপদে আমাদের পড়তে হতো না।’ এশিয়া অঞ্চলের অভিবাসন ও প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা কারাম এশিয়া। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় মালয়েশিয়ায়। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হারুন-অর-রশীদ প্রথম আলোকে জানান, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে বাংলাদেশের দালালদের সহায়তায় নামসর্বস্ব অনেক মালয়েশিয়ান কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়ে এসেছিল। কিন্তু পরে এই কোম্পানিগুলো উধাও হয়ে যায়। ফলে যাঁরা চলে আসেন, তাঁরা কাজ পাননি। অন্য জায়গায় পরে কাজ নিলেও কোম্পানির মূল মালিক না থাকায় তাঁরা এখন অবৈধ। ফলে তাঁদের ভিসা নবায়ন হচ্ছে না। আর মালিক না থাকায় শ্রমিকদের এখন ভিসা নবায়নের জন্য আবার দালালদের কাছে যেতে হচ্ছে। কিন্তু দালালেরা অনেক সময় তাঁদের কাছ থেকে টাকা ও পাসপোর্ট নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া সরকার বারবারই বাংলাদেশের এসব দালালকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেটি করতে পারছে না। সমস্যার সমাধানে করণীয় কী, জানতে চাইলে কারাম এশিয়ার প্রধান বলেন, এ ব্যাপারে এখন মূল ভূমিকা রাখতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। তাদের সমস্যাটা চিহ্নিত করে, তথ্যপ্রমাণসহ মালয়েশিয়া সরকারকে বোঝাতে হবে। কারণ, এই শ্রমিকেরা দুই দেশের সরকারের অনুমতিতেই এখানে এসেছে। কূটনীতিকেরা এ ব্যাপারে দক্ষভাবে কাজ করলে সমস্যার সমাধান সম্ভব। সমস্যার সমাধানে দূতাবাস এখন পর্যন্ত কী উদ্যোগ নিয়েছে, জানতে চাইলে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের হাইকমিশনার আতিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য দেশের শ্রমিকদেরও একই সমস্যা। এটি সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অভিবাসন দপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরা অবৈধ বাংলাদেশিদের খুব শিগগির বৈধ করবেন বলে জানিয়েছেন। দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) মাসুদুল হাসান সাংবাদিকদের জানান, ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে যাঁরা আছেন, মালয়েশিয়া সরকার তাঁদের রাখবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। আর কলিং ভিসায় যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের বায়োমেট্রিকস (হাতের ছাপ) তথ্য মালয়েশিয়ার যে কোম্পানি রাখত, তারা সেটা নষ্ট করে ফেলেছে। এখানকার অভিবাসন দপ্তর আবার সব তথ্য নিচ্ছে। ফলে অবৈধ ব্যক্তিদের ভিসা দেওয়ার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে হচ্ছে। এখন মাসে গড়ে ৪ হাজার লোক বৈধতা পাচ্ছেন। খুব শিগগির এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সর্বশেষ বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এসেছিল। তারা মালয়েশিয়া সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করেছে। মালয়েশিয়া সরকার দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসেই দেখা হয় মালয়েশিয়ার ১ জন অভিবাসন কর্মকর্তা ফরিদউদ্দিনের সঙ্গে। মালয়েশিয়ার পুলিশ কেন বাংলাদেশিদের হয়রানি করছে, জানতে চাইলে তিনি জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়া তাঁর এ বিষয়ে কোনো কিছুই বলার নেই। মালয়েশিয়ায় অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা তেনেগানিতা। এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক, মানবাধিকার কর্মী ও বিকল্প নোবেলজয়ী আইরিন ফার্নান্দেজ সাংবাদিকদের বলেন, মালয়েশিয়া নিজের প্রয়োজনেই বাংলাদেশ থেকে কর্মী এনেছে। কাজেই এখন শ্রমিকদের ভিসা নবায়ন না করাটা অনৈতিক। অভিবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে কোনো নীতি না থাকায় এ সমস্যা হচ্ছে। এর সমাধান হওয়া জরুরি। সরকারের উচিত দ্রুত এই শ্রমিকদের বৈধতা দেওয়া। জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল রাতে ফোনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশিদের ভিসা নবায়ন ও বৈধতা দেওয়ার ব্যাপারে সে দেশের সরকারের সঙ্গে সর্বাত্মক আলোচনা চলছে। সম্প্রতি কুয়ালালামপুর সফরের সময় সে দেশের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি তোলার পর তাঁদের ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ করেছি।’ কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী গত ১২ থেকে ১৫ ডিসেম্বর কুয়ালালামপুর সফর করেন। এ সময় তিনি মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দিন বিন মোহাম্মদ ইয়াসিন এবং শ্রম ও মানবসম্পদমন্ত্রী এস সুব্রামানিয়ামের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকগুলোতে খন্দকার মোশাররফ বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসা নবায়নের পাশাপাশি কাগজপত্র নেই এমন লোকজনের বৈধতা দেওয়ার বিষয়ে অনুরোধ জানান।