জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী ২০টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ৩১টি অভিযোগ করা হলেও তথ্য-প্রমাণ এবং আলামতের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল ২০ অভিযোগ আমলে নিয়েছেন।

সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩ হাজারের বেশি নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা, ৯ জনের বেশি নারীকে ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, লুটপাট, ভাংচুর এবং একশ’ থেকে দেড়শ’ হিন্দুকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে।

 সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৩ মে পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় পিরোজপুরে সেনা ও রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এর নেতৃত্ব দেন সাঈদী। পরে ৪ মে সকাল সোয়া ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত নারকীয় হত্যাষজ্ঞ চালায় এ হানাদার বাহিনী। এরা পিরোজপুরের মাছিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে জড়ো হওয়া নিরীহ ২০ বাঙালি ও মাছিমপুরের হিন্দুপাড়ায় বিজয় কৃষ্ণ মিস্ত্রী, উপেন্দ্রনাথ, যোগেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ, মতিলাল, যজ্ঞেশ্বর মণ্ডলসহ ১৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে। তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, সাঈদীর নেতৃত্বাধীন একই বাহিনী ৪ মে পিরোজপুর শহরের কালিবাড়ী রোড, মাছিমপুর, পালপাড়া, শিকারপুর, কুকারপাড়া, ডুমুরতলা, তেলিখালী, কদমতলা, নওয়াবপুর, পাড়েরহাট, টেংরাখালীসহ অসংখ্য হিন্দু এলাকায় অগি্নসংযোগ ও লুটপাট চালায়। তা মানবতাবিরোধী অপরাধের ৩(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ সময় ধোপাবাড়ীর সামনে এলজিইডি ভবনের পেছনে স্থানীয় দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল, খগেন্দ্রনাথ, পুলিন বিহারী, মুকুন্দ বালাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।

১৯৭১ সালের ৫ মে হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিয়ে অভিযোগে বলা হয়েছে, ওইদিন দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে পিরোজপুরের তৎকালীন এসডিপিও ফয়জুর রহমান আহমেদ (কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাবা) ও এসডিও আবদুর রাজ্জাক, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহমানসহ আরও কয়েকজনকে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে বলেশ্বর নদীর পাড়ে এনে লাইনে দাঁড় করে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে ৭ মে পিরোজপুর পাড়েরহাট বন্দরে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাখনলালের দোকানসহ ৩০-৩৫টি দোকানে অগি্নসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। এরপর ৮ মে দুপুর সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সাঈদীর নেতৃত্বাধীন বাহিনী পাড়েরহাট গ্রামের নূরুল ইসলাম প্রকাশ, আইয়ুব আলী তালুকদার, মানিক পশারী ও তার ভাইয়ের নতুন বাড়িসহ ১২টি বাড়ি ও হিন্দুপাড়ায় হিমাংশ হাওলাদারসহ অনেকের বাড়িঘরে অগি্নসংযোগ করে লুটপাট চালানো হয়। এসব ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন সাঈদী। ৩ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে যে কোনোদিন পিরোজপুরের বাগমারা গ্রামের ভাগীরথীকে গুলি করে হত্যার পর নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া, ৮ মে মানিক পশারী ও তার ভাইয়ের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে হত্যা, ২৫ মে থেকে ৩১ জুনের মধ্যে নলবুনিয়া গ্রামে আজহার আলীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার ছেলে সাহেব আলীকে হত্যার পর নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া, ২ জুন বিশা আলীকে নারিকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা। অন্যান্য অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৫ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত আদাকুল গ্রামের বিমল হাওলাদারের ভাই ও বাবাকে ধরে কুড়িয়ানা হাই স্কুল ক্যাম্পে নিয়ে তাদেরসহ নিরীহ আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার বাঙালিকে পেয়ারা বাগানে নিয়ে হত্যা, ২৫ মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত যে কোনো একদিন হোগলাবুনিয়া গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে তরণী সিকদার ও তার ছেলে নির্মল সিকদার, শ্যামকান্ত সিকদার, বাণীকান্ত সিকদার, হরলাল কর্মকার, মাইঠভাঙ্গারের প্রকাশ সিকদারসহ ১০ জনকে গুলি চালিয়ে হত্যার পর নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া, ৪ মে থেকে ১৬ ডিসেম্ব্বরের মধ্যে পাড়েরহাটে আক্রমণ করে হরলাল মালাকার, অরকুমার মির্জা, তরণীকান্ত সিকদার, নন্দকুমার সিকদারসহ ১৪ হিন্দুকে রশিতে বেঁধে পাকিস্তানি সেনা ছাউনিতে নিয়ে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া।
সাঈদীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগও রয়েছে। এ বিষয়ে অভিযোগ গঠনের আদেশে বলা হয়েছে, ১ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে হোগলাবুনিয়া গ্রামের মধুসূধন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামীকে আটক করে ধর্ষণ, ২৫ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে উমেদপুর পাড়েরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার তিন বোন মহামায়া, অন্যরানী ও কমলা রানীকে সেনাক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ, ৩ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিপদ সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে নিজ বাড়িতে আটকে নিয়মিতভাবে ধর্ষণ। এছাড়া ২৫ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে পাড়েরহাট বন্দরের কৃষ্ট সাহাকে হত্যার পর তার মেয়েসহ হিন্দুপাড়ার অসংখ্য নারীকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে ধর্ষণের পর ২৫ জুন থেকে ৩১ জুনের মধ্যে মধুসূদন ঘরামী, অজিত কুমার শীল, বিপদ সাহা, নারায়ণ সাহা, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল, হরিলাল, অমূল্য হাওলাদার, শান্তি রায়, জুরান, ফকির দাস, জোনা দাসসহ ১০০-১৫০ হিন্দুকে ধর্মান্তরে সাঈদী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।