একটু বিশ্রামের আশায় রাতদিন দৌড়-ঝাঁপ দিয়ে অবিশ্রাম পরিশ্রম করে মানুষ। দৌড়ঝাঁপের গতি যখন ফুরিয়ে আসতে থাকে তখনই কেউ কেউ টের পায় ভেতর দেহের নড়বড়ে অবস্থা। সাড়ে তিন হাত এই দেহ বিলাসের দমের জন্য কতই না আয়োজন করে সে। ক্ষতবিক্ষত করে পবিত্র আত্মা আর দেহকে। মানুষ কি কখনও ভেবে দেখেছে তার চির বিশ্রামের স্থানটি মাত্র সাড়ে তিন হাত মাটির! যন্ত্র সভ্যতার এই যুগে মানুষ যেন যন্ত্রের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে ছুটছে। যন্ত্রের স্রষ্টা এই মানুষের কবে হুঁশ হবে? যেদিন মানুষের হুঁশ ফিরবে সেদিনই সে চিনতে পারবে নিজেকে। নিজেকে চিনতে পারলেই মানুষ আপন প্রয়োজনে তৈরি করে নেবে পরিকল্পিত বিশ্রাম। কেবল পরিকল্পিত বিশ্রামী মানুষই গড়ে তুলতে পারে সুন্দর অনাগত এক পৃথিবী। জীবনের জন্যই বিশ্রাম। বিশ্রামের জন্য জীবন নয়।

জীবনে সফল হতে হলে অবশ্যই কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে হবে। কিন্তু শুধু যদি কাজ, কাজ আর কাজ নিয়েই কেউ পড়ে থাকে তাহলে তার যে ক্ষয় হবে সেটা পোষাবে কিসে? এই ক্ষয় আটকাতে প্রয়োজন বিশ্রাম। প্রত্যেকবার কাজের পর মানুষ যে ক্লান্ত হয় তা থেকে নতুন উদ্যম জোগায় বিশ্রাম। এভাবে মানুষ যত দিন বেঁচে থাকবে কাজ তো তাকে করেই যেতে হবে কিন্তু সারাদিনের কর্মক্লান্তির অবসাদ ঘুচাতে হাত-পা ঝেড়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নিতে পারাটা কম কিসে?

কীভাবে হয় বিশ্রাম

এটি হচ্ছে এমন একটি ব্যাপার যার মাধ্যমে শরীর ও মন থেকে দূর হয় ক্লান্তি আর অবসাদ। বিশ্রামের পর শরীরে নতুনভাবে শক্তি সঞ্চারিত হয় এবং মনে আসে উত্সাহ। পরবর্তী একটি কাজের জন্য উদ্দীপনা জাগে। সোজাসাপ্টা ভাষায় আমরা বুঝি, কোনো কাজ না করে শুধু শুয়ে বসে থাকলেই হয় বিশ্রাম। কিন্তু সবসময় এটা করা হয় না। কিন্তু কেন? জীবনের ভারে মনটা যখন ভারাক্রান্ত হয় ঠিক তখনই আসে রিলাক্স বা বিশ্রাম নেওয়ার কথাটি। যে অবস্থায় শরীরটা হয় শিথিল আর মনে আসে একটা আবেশ। যেন শরীর দিয়ে মনটাকে ছুঁয়ে নেওয়া। এটাই তো বিশ্রাম। আজকের গতিশীল জীবনে বিশ্রাম হচ্ছে অপরিহার্য অনুষঙ্গ।

বিশ্রাম করতেও জানতে হয়

কি নারী, কি পুরুষ সবাই যেন এখন শুধু ছুটছে আর ছুটছে। ঘরে বাইরে শুধু কাজ আর কাজ। হাজার কাজের ফাঁকে নিজেকে ঝরঝরে করতে চায় সবাই। তাই তো বলা যায়, পরিশ্রম ও বিশ্রাম যেন একই বৃন্তে দুটি ফুল।

বিশ্রাম করতে জানাটাও আসলে আয়ত্ত করতে হয়। একেকজন একেকভাবে এটা কাল্টিভেট করে থাকেন। তাই দেখা যায়, বিশ্রাম যেন একটা সাইক্লিক প্রসেস। একের পর এক জুড়েই যাচ্ছে। কাজ, বিশ্রাম এবং কাজ।

এই কাজেরও রয়েছে রকমফের। কারোবা কায়িক পরিশ্রম বেশি, আবার কারও মাথা খাটানোর। এরপরও কাজের থাকে সময়ভেদ। এ কারণে সবারই আয়ত্ত করতে হয় নিজের মতো করে বিশ্রামের পদ্ধতি। সময়ের কাজ সময়ে সেরে ফেললে কাজের চাপ বাড়ে না। আর চাপ না বাড়লে ক্লান্তি আসে না। যেকোনো কাজ আন্তরিকতার সঙ্গে মন দিয়ে না করলে মনকে ক্ষত-বিক্ষত করে বিবেক। আর এর থেকে আসে এক ধরনের অপরাধবোধ।

এ রকমের অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটাই পথ, তা হলো সঠিক খাতে সময় ব্যয় করা। ঘরের বাইরের জগতে যাদের বেশি দৌড়াতে হয় তাদের জন্য কাজের সুষ্ঠু পরিকল্পনা খুবই জরুরি। এটা নারী-পুরুষ সবার জন্যই প্রযোজ্য।

এক নজরে বিশ্রাম

বেশি কাজের চাপে ক্লান্ত বলে যেমন কারও দরকার হয় বিশ্রাম আবার সারাদিনের কর্মহীন, আড্ডাবাজ, বেকার ব্যক্তিটিরও প্রয়োজন বিশ্রামের। প্রথমজনের শারীরিক আর দ্বিতীয়জনের মানসিক বিশ্রাম দরকার। এর রয়েছে নানা রকম পদ্ধতি। শুধু শুয়ে বা বসে থেকেই বিশ্রাম হয় না। কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে গাড়িতে মাথাটা হেলিয়ে প্রিয় শিল্পীর গান শোনও যেমন বিশ্রাম আবার ঘরে বসে মিউজিক ছেড়ে, বই পড়তে পড়তেও হয় বিশ্রাম।

কীভাবে করবেন

বসে বা শুয়ে শরীরের পেশিকে শিথিল করতে হয়। এই শিথিল করা প্রক্রিয়া তখনই কার্যকর হবে যখন দেখবেন শরীরটা ভারী এবং অবশ হয়েছে।

সম্মোহনের মাধ্যমে রোগীদের বিশ্রামে নেওয়া হয়। এটা সুস্থ মানুষও করতে পারে। এটা করার জন্য বিশেষ কোনো ইন্দ্রিয়ের ওপর মন স্থির করতে হয়। এটা হঠাত্ হয় না। ধীরে ধীরে আয়ত্ত করতে হয়।

শিশুকালে দোলনায় বাবা-মায়ের কোলে দোল খায়নি এমন মানুষ বিরল। এই দোল হচ্ছে শরীরে একটা ছন্দের অনুভূতি। এতে শরীরের পেশি শিথিল হয়ে মন অবশ হয়ে আসে। এ কারণেই সম্ভবত মানুষ ভ্রমণকালে ট্রেনে বা বাসে ঘুমিয়ে পড়ে।

আর চিরচেনা এই পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে আধুনিক রকিং চেয়ারের, যা হতে পারে বিশ্রামের জন্য আদর্শ এবং লেটেস্ট। প্রতিদিনের সমস্যার ক্লান্তিতে বিশ্রাম প্রতিদিনকার নানা রকমের সমস্যাজনিত কারণে প্রায় সবার জীবনেই আসে ক্লান্তি। এতসব সমস্যার মাঝে সব যে ফেলে দেওয়ার তাও নয়। কোনোটা হয়তো সাধারণ আবার কোনোটা গুরুতর। সমস্যা ছোট বা বড় যাই হোক ক্লান্তি তো ক্লান্তিই। এর থেকে রেহাই পেতে জটিলতাবর্জিত কিছু সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিত্সক। সমাধানগুলো হতে পারে তাত্ক্ষণিক অথবা দীর্ঘমেয়াদি। গুরুত্ব বুঝে মেনে চলা। প্রতিদিনকার এসব সমস্যার সমাধান মানেই হলো শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম।

আমাদের মস্তিষ্কের রয়েছে দুটি বিভাগ। রাইট হেমিসফেয়ার ও লেফট হেমিসফেয়ার। ডানের অংশ কাজ করে অনুভূতিতে আর বামেরটি যুক্তিতর্কে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা বাঁ দিকের অংশটি বেশি উজ্জীবিত হয়। আমাদের তর্ক করার মনোভাবকে জাগিয়ে তোলে। তখন অনভূতির দিকটা হয়ে পড়ে গুরুত্বহীন। আমরা এটা অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় মনে করি। কিন্তু কখনও কখনও মস্তিষ্কের ডান পাশটিকে উজ্জীবিত করতে হয় তাহলে শরীরে আসে শিথিলতা ও মনটা ভরে যায় আবেশে।